লুসিফারের লোকজন
জানাডুর নড়বড়ে ইজিচেয়ারটায় হেলান দিয়ে
বসেছিল ম্যানড্রেক। কথা বলছিল আস্তে আস্তে। চোখ বুজে। এতক্ষণে তাকায় আমার দিকে ফিরে, চিনচিনে
ভাবটা কাটল?
একপাশে
মাথা হেলাই আমি।
আগের
কথার সূত্র ধরেই আবার বলে ম্যানড্রেক, ভগবান হওয়ার সাধ আমার নেই বন্ধু। অনেক
দায়িত্ব সর্বশক্তিমানের...
যদিও
দেখিনি ভগবানকে, বোধহয় মানিও না বিশেষ ভদ্রলোককে, তবু মনে হচ্ছিল— সর্বশক্তিমান
দূরের কথা, সামান্য ম্যানড্রেক বলে এই লোকটাকে মানতেও যেন সায় পাচ্ছি না ভেতর থেকে। কিন্তু জলজ্যান্ত যা সব
নমুনা দেখতে হচ্ছে সেই দুপুর থেকেই পরপর...
টের
পাচ্ছি অল্পই চিনতাম ম্যানড্রেককে এতদিন। আসলে ওই যে ব্যাকব্রাশ চুল,
পেনসিল গোঁফ, নীল কোটের উপর লাল উড়নি— ম্যানড্রেকের চেহারাই নয় ওটা। স্রেফ লি ফকের কল্পনা
ওগুলো। যেমন বেথলেহেমের জেশাস কল্পনায় হয়ে গিয়েছেন রোমান দেবতা। আবার এটাও ঠিক— ওই
কাল্পনিক ছবিটা না এঁকে উপায়ও ছিল না লি ফকের। যেহেতু ম্যানড্রেককে প্রোটাগনিস্ট
করে কোনও উপন্যাস নয়, ভদ্রলোক নামাচ্ছিলেন একটা কমিক স্ট্রিপ।
বরং
গোড়া থেকেই বলি।
শখেরবাগানে
কাজ ছিল একটা। সকাল-সকালই এসে গিয়েছিলাম স্টেশনে। কিন্তু কপালে যেদিন লেখা থাকে ভোগান্তি!
তিন ঘণ্টা অবরোধের পর এল গাড়ি। গেদেঠেসে দাঁড়াবার জায়গা যাও বা
একটা পেলাম, ভয় হচ্ছিল নামার কথা ভেবে। অনেকক্ষণ আটকে থাকার রাগ থেকেই হয়তো উল্কার
গতিতে ছুটছিল ট্রেনটা। দরজার গোড়া থেকে শুরু হওয়া নামার লাইনের ল্যাজা পৌঁছে
গিয়েছে তখন প্রায় জানলার ধারে। বেঁকেচুরে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে ভাবছিলাম— যা অবস্থা, সামান্য
একটু ঠেলা বা দুটো বেশি কথা থেকেই না বেধে যায় এখন লঙ্কাকাণ্ড।
আর
ভাবতে ভাবতেই...
দু’-চার
কথায় শুরু হয়ে গেল চেঁচামেচি। মধ্যতিরিশের বেঁটেখাটো কালোকেলো চেহারার
লোকটার সঙ্গে বেশ চকচকে এক তরুণীর। গলার পর্দা যদিও চড়ছিল মেয়েটিরই।
ঠেলছেন
কেন অসভ্যের মতো? মেয়েছেলে দেখেননি...
ইচ্ছে
করে ঠেলিনি। সামনেই নামব। চাপ আসছে পেছন থেকে ভীষণ। ব্যাপারটা বুঝুন।
বোঝাবুঝির
কিছু নেই। এসব অভদ্র পুরুষমানুষদের মুখ দেখলেই বোঝা হয়ে যায় যা বোঝার। থাবড়ে গাল লাল করে দিতে
হয় একদম...
লাল
হয়ে উঠছিল আমারই কানের লতি। যেভাবে পশুর মতো গেদেঠেসে দাঁড়িয়ে থাকতে হচ্ছিল
আমাদের— শরীরে শরীর ঠেকে না যাওয়াটাই সেখানে আশ্চর্যের। তাও ধারেকাছে মহিলা দেখলে
যতটা হয় সাবধানেই দাঁড়ায় লোকজন। তারপরও অনিচ্ছাকৃত ছোঁয়া যেটুকু
লেগেই যায়...
কিন্তু
এত কথা বলা যায় না সব জায়গায়। রাস্তাঘাটে নারী-পুরুষের ঝামেলায়
দ্বিতীয়জনের পক্ষ নিতে যাওয়াও আজকাল বিপদের। রেপ বা ইভটিজিং-এর সময় টিকি দেখা
যায় না যাদের, এসব খুচখাচ ঝামেলায় তারাই এক-একজন হিম্যান। আর চেনা স্ক্রিপ্টে
শুরুও হয়ে গিয়েছে তখন সিনেমা।
নোংরামি
করতে উঠেছ চাঁদ ভদ্দরলোকের ছাল চাপিয়ে...
ক্যালা
হারামজাদাকে প্লাটফর্মে নামিয়ে। দুর্ভোগের বদলা নিই শালা হাতের সুখ করে...
লঙ্কা
ছিঁড়ে না ধরিয়ে দেব এখনই হাতে। বেরিয়ে যাবে এক্কেবারে সব ঝাল...
বুকের
মধ্যেটা গুরগুর করে উঠছিল আমার। বেশ বুঝতে পারছিলাম আর দেরি নেই...
খড়কুটো
আঁকড়ে যেভাবে বাঁচতে চায় ডুবন্ত মানুষ প্রায় সেই ভঙ্গিতেই আশপাশের ভিড়টার দিকে তাকিয়ে
বলল লোকটা, উনি নামবেন না এখন। আবার সরেও দাঁড়াবেন না একটুও। কী করে যাব গেটের দিকে
বলতে পারেন?
জানি
না কীভাবে যাবেন, চারপাশের অসভ্যতাকেও এবার ছাপিয়ে উঠল মেয়েছেলেটির গলা, সরব না
একটুও আমি। টাচ না করে যেভাবে খুশি যান। দেখার দরকার নেই আমার। ননসেন্স...
বেশ।
তাই হোক...
পরক্ষণেই
সেই ভোজবাজি। চোখের পলক পড়েছিল বড়জোর। তাকিয়ে দেখি দরজার হাওয়া খেতে
খেতে কামরার ভেতরের দিকে তাকিয়ে হাসছে বেঁটেখাটো লোকটা। মুখের কথা না খসতেই অন্তত
কুড়িটা লোককে টপকে পৌঁছে গিয়েছে গেটে! ট্রেনের চাকার শব্দটা বাদে কামরায় তখন ঠিক
পিন-ড্রপ সাইলেন্স।
গতি
কমছিল ট্রেনের। প্লাটফর্ম আর দূরে নেই। সেই মেয়েটির হতভম্ব গলাই শোনা গেল প্রথমে,
কীভাবে গেলেন ওখানে? এই তো ছিলেন...
আপনার
দেখার দরকার নেই তো, একগাল হাসল লোকটা, টাচ লাগল নাকি বলুন। এভাবেই তো আসতে বলছিলেন
আমায়...
আর-একটা
কথা নেই কামরায়। আর-একটা শব্দ নেই। প্লাটফর্মে ঢুকে পড়ে ঢিমেতালে
এগোচ্ছিল গাড়িটা। কে বলবে অল্প আগেই এখানে বাধতে বসেছিল এক খণ্ডযুদ্ধ। একটা
হালকা ঝাঁকুনি দিয়ে থেমে গেল ট্রেনটা। পাশ কাটিয়ে নামার সময় আপনা থেকেই মেয়েটির
দিকে চোখ চলে গিয়েছিল আমার। কী যে ছিল তার চোখের তারায় বলতে
পারি না। তবে আচমকা মনে হল, আর কখনও মেয়ে হওয়ার সুযোগ নেওয়ার মতো অসভ্যতা করবে না
সে।
প্লাটফর্ম
তখন ছোটখাটো মেছোহাটা। তিন ঘণ্টা পরে গাড়ি এলে যা হয়। কিন্তু সেই ডামাডোলের মধ্যেও
আমার চোখ ঘুরছিল লাটাইয়ের মতো। গেল কোথায় লোকটা! আর কি দেখা পাব! যদিও দেখতে পেলেও
কী বলব— ভাবিনি তখনও।
কিন্তু
কপালে থাকলে দেখা পাওয়া যায় স্বয়ং ভগবানেরও। ইতিউতি তাকাতে তাকাতেই আবার দেখতে
পেলাম। চারের প্লাটফর্মের ভাতের হোটেলের লাগোয়া রেলের পাঁচিলের
একটা ফোকর গলে বাইরে বেরিয়ে যাচ্ছিল সে। রইল মাথায় শখেরবাগানের কাজ। ভিড় ঠেলে
দ্রুতপায়ে ছুটলাম তার পিছু পিছু।
স্টেশনের
গায়ে লাগা সংকীর্ণ একটা পায়ে চলা ইটের রাস্তা ধরে হাঁটছিল লোকটা। পথের লাগোয়া দু’-একটা
ঝুপড়ি দোকান আর নীচু নীচু একরাশ ইটের ঘর। সম্ভবত রেলের একেবারে নীচুতলার কর্মীদের
বসবাসের কোয়ার্টার হিসেবে ব্যবহার হয় ঘরগুলো। কাজের সূত্রে যাতায়াত ছিল
এই তল্লাটে আমার। কিন্তু এই রেলকলোনিটার ভেতর ঢোকা হয়নি কোনওদিন। সামান্য দূরত্ব রেখে
অনুসরণ করছিলাম। খুব কাছে যেতে ভরসা হচ্ছিল না। ঘুরে তাকিয়ে যদি জিজ্ঞাসা
করে কিছু! আবার খুব পিছিয়ে থাকতেও ভরসা হচ্ছিল না। যদি হারিয়ে যায় চোখের আড়ালে!
কেন পিছু নিয়েছিলাম নিজেও জানতাম না অবশ্য। খালি মনে আছে মন্ত্রমুগ্ধের মতো
হাঁটছিলাম এ-গলি থেকে সে-গলি।
যে
ভোজবাজি দেখলাম নিজের চোখেই— কী বলা যায় তাকে! এ কি বাস্তব! নাকি জাদু! নাকি একেই
বলে জাদুবাস্তব! বাস্তবে কি ঘটা সম্ভব তাহলে জাদুবাস্তবের চমক! আজকের জলজ্যান্ত
অভিজ্ঞতার পর আর নাকচ করি কী করে সেই সম্ভাবনা! তাছাড়াও বাস্তবকে তাচ্ছিল্য করে
জাদুবাস্তবকে মাথায় তুলে নাচানাচি তো এতকাল করলাম আমরাই। এত বক্তিমের পর আজ তবে সমস্যা
হচ্ছে কোথায় হাতেগরম একটা ঘটনাকে সত্যি বলে মেনে নিতে! রাশি রাশি প্রশ্ন ঘুরপাক
খাচ্ছিল মাথায়। বোধহয় যুতসই একখানা সদুত্তরের আশাতেই মরিয়া হয়ে পিছু নিয়েছিলাম
লোকটার। আর খালি মনে হচ্ছিল— যতই গলাবাজি করি না কেন, আসলে প্রতিটি
প্রাণীই আমরা ঘোরতর ভাবে বাস্তববাদী। আর ফর্ম নিয়ে যত মাথাব্যথাই দেখাই না কেন,
চেনা কনটেন্টের একটু হেরফের হয়ে গেলেই মাথা বিগড়ে যায় আমাদের।
কোন
রাস্তা, কোন গলি দিয়ে কতক্ষণ হাঁটছি হুঁশ ছিল না। শেষে পুরনো একটা পাড়ার পলেস্তরা
খসা একটা দোতলা বাড়ির সামনে এসে থামলাম। থামলাম। মানে লোকটাই আসলে থেমে
গেল বাড়িটার সামনে এসে। দোতলাই বলতে হবে বাড়িটাকে। যদিও দোতলা বাড়ি বলতে যা বোঝায় ঠিক
তেমন ছিল না বাড়িটা। একতলা বলতে ছিল না কিছুই এক্ষেত্রে। চারটে মোটা মোটা থামের
ভরে ঝুলছিল দোতলার ক’টা ঘর। মাটি থেকে দু’-তিনটে পাক খেয়ে উঠে গিয়েছিল সিঁড়ি। অদ্ভুতদর্শন
বাড়িটার সামনে এসে এতক্ষণে পিছন ফিরে তাকাল বেঁটেখাটো কালোকেলো লোকটা।
পঞ্চাশটা
গল্প লেখা হয়ে গেল। এখনও ধন্দ কাটল না বাস্তব-জাদুবাস্তব-অ্যাবসার্ডিটির?
হো
হো করে হাসতে লাগল সেই রহস্যময় লোকটা আমার দিকে তাকিয়ে।
কী
বলতাম জবাবে! চমকের পর চমকে তখন স্রেফ হতবুদ্ধি আমি। এ কার পাল্লায় পড়লাম এসে? দিনরাত
খালি ভেলকি দেখিয়েই বেড়ায় নাকি এই লোক? নাকি অন্তর্যামীও?
থট
রিডিং-টা কোনও ভেলকির ব্যাপারই নয় বন্ধু, হাসি থামিয়ে আবার বলল সে, যাই হোক, এই হল
জানাডু। হেঁটে আসতে হয়েছে অনেকটা। একটু বসতে আজ্ঞা হোক।
জানাডু!
এতক্ষণে কথা সরল আমার মুখে, তার মানে... ম্যানড্রেক...
যাক।
চিনতে পারলে। ম্যানড্রেকই।
লোথার,
নার্দা...
নেই।
কেউ নেই। হোজোও নেই। ওরা সব লি ফক সাহেবের কল্পনা। কিন্তু ম্যানড্রেক সত্যি।
আর
সেই ক্রিস্টাল কিউব...
শুরুতেই
সব জেনে ফেলবে বন্ধু! তোলা থাক না যথাসময়ের জন্য একটুখানি রহস্য...
কিন্তু...
আবার
কিন্তু! ঠিক হজম হতে চাইছে না, তাই তো! আবার যা দেখলাম ট্রেনে...
অনেকটা
সেরকমই, আমতা আমতা করি আমি, আর সেই জানাডু তো ছিল পাহাড়ের মাথায়। কী সব কারুকার্য
ঢোকার রাস্তায়...
রং
না চড়ালে কি আর গল্প জমে বন্ধু, আবার হা হা করে হেসে ওঠে ম্যানড্রেক, তুমিও তো
লেখো-টেখো। ভাল বুঝবে। তবে সবটা কল্পনা না-ও হতে পারে। হয়তো সবই হবে একে-একে।
লোথার, নার্দারাও আসবে সময় হলে। সময়টাই হয়নি এখনও। আগেভাগেই লিখে দিয়েছেন সাহেব। রাম না হতেই যেমন
রামায়ণ...
কিন্তু,
তখনও মেনে নিতে পারছিলাম না মন থেকে, তবে তো জ্যোতিষী বলতে হয় লি ফককে...
অত
দরকার আছে কি কার্যকারণের সুতো খোঁজার, হাসিমুখেই বলে ম্যানড্রেক, অত গালভরা
শাস্ত্রবিরোধী আন্দোলনটার কী হবে তাহলে?
সেই
আলাপ হয়ে গেল ম্যানড্রেকের সঙ্গে। কথায় কথায় জানলাম অনেক আগে এসব চত্বর ছিল স্রেফ জলা-জংলা-কচুবনে
ঢাকা। অল্প দূরেই খাটাল। চব্বিশ ঘণ্টা কানের গোড়ায় মশার পোঁ-পোঁ। দোতলায় উৎপাত খানিক কম
হতে পারে ভেবে বাড়ি তোলার সময় একতলাটাকে স্রেফ ছেঁটে দিয়েছিলেন থেরন। চারটে থামের
ভরে শূন্য থেকে ঝুলিয়ে দিয়েছিলেন গোটা বাড়িটাকে। মাটি থেকে দু’-তিনখানা পাক খাইয়ে
তুলে দিয়েছিলেন সিঁড়ি। এই ব্যাপারটাকেই গল্পে রং চড়িয়ে পাকদণ্ডী পথে পাহাড়ের মাথায়
নিয়ে চলে যান লি ফক।
শুনতে শুনতে সব তালগোল পাকিয়ে যাচ্ছিল আমার।
কিছু-কিছু হিসেব বেশ মিলে যাচ্ছিল। কিন্তু মিলছিল না বেশিটাই। অথবা হয়তো মিলবে
ভবিষ্যতে। যেমনটা বলল তখন ম্যানড্রেক। দেখা যাক। গায়ের রং বদলে ফেলাও কি ভাবীকালের
বিজ্ঞানের কাছে খুব একটা বিরাট ব্যাপার! পরীক্ষা-নিরীক্ষা তো চলছে শুনি। বাজারের কাগজেও রোজই চোখে
পড়ে একটা-আধটা বিজ্ঞাপন। দেখাই যাক না অপেক্ষা করে।
পরখ
করার ইচ্ছেটা অবশ্য কাটছিল না কিছুতেই।
গলির
মুখের দোকান থেকে কিনে আনা কষা-কষা গরুর মাংস দিয়ে গরম রুটি খেয়ে নিয়ে আয়েশ করে
বসলাম জানাডুর চৌকিতে।
তোমার
যখন এত ক্ষমতা, আবার বলি আমি, ঝামেলাটাকে বাড়তে দিলে কেন অতদূর? ভেলকিটা শুরুতে
দেখিয়ে দিলেই তো আর খেতে হয় না অত গালাগাল। তাছাড়া অতগুলো মানুষকে দুর্ভোগেই বা
পড়তে দিলে কেন? ম্যাজিক দেখিয়ে অবরোধটা তো হটিয়ে দিতে পারতে গোড়াতেই?
নড়বড়ে
ইজিচেয়ারটায় কায়দা করে হেলান দিয়ে আমার দিকে তাকিয়েছিল ম্যানড্রেক। গোড়াতেই
বলেছিল, ইজিচেয়ারটাতেই বসতে দিতাম। কিন্তু একটু কায়দা করে সাবধানে বসতে হয়। ছাড়ো, তুমি বরং বসো
চৌকিতেই।
আমার
কথায় জ্বলজ্বল করে উঠল ম্যানড্রেকের চোখদুটো। পরক্ষণেই চোখ বুজে ফেলল সে। আর ঠিক
তখনই বোধহয় পলকের জন্যেই মাথার মধ্যে টের পেলাম চিনচিনে অনুভূতিটা। কিন্তু ওই পলকের
জন্যেই। পরক্ষণেই সব স্বাভাবিক। তাকিয়ে দেখি চোখ বুজে ইজিচেয়ারে
শুয়ে আছে ম্যানড্রেক।
জবাবটার
জন্য অপেক্ষা করতে করতে যখন ভাবছি আবার করব নাকি প্রশ্নটা ঠিক তখনই চোখ বোজা
অবস্থাতেই ধীরে ধীরে মাথা নাড়তে শুরু করল ম্যানড্রেক, বুজতেই হল চোখদুটো। কারণ, যে প্রশ্নটা করলে
তুমি, জবাব দিতে গিয়ে যদি এখন তাকিয়ে থাকতাম তোমার দিকে, সম্মোহিত হয়ে পড়তে। কানে শুনতে, কিন্তু কিছুই
আর মনে রাখতে পারতে না। ঠিক ট্রেনের কামরায় তখন যেমন হল...
বাধা
দিয়ে বললাম আমি, কী হল ট্রেনের কামরায়? বলতে চাইছ সারা কামরার লোক সম্মোহিত হয়ে
পড়েছিল?
মাথাটাকে
অল্প নেড়ে বলল ম্যানড্রেক, নইলে কি তোমার মনে হয় উড়ে গেলাম কামরার গেটে?
আমি
নিরুত্তর।
ম্যানড্রেক
বলে যায়, হয়তো খেয়াল করেছ, ভেলকিটার আগে আগে তাকিয়েছিলাম লোকগুলোর চোখের দিকে
ঘুরে। তখন থেকেই শুরু খেলাটার। মামুলি একটা সম্মোহন। চার-পাঁচ সেকেন্ডের বেশি টেকে
না। সবার শেষে তাকিয়েছিলাম মেয়েটার দিকে। তাই ভেলকির আগে আগে শেষ কথাটা বলতে
পেরেছিল ও-ই। ভিড় ঠেলেই গেছি কামরার গেটে। সবাই দেখেছে। কিন্তু মনে রাখতে পারেনি
কিছুই। সম্মোহিত ছিল বলেই। বাধাও দিতে পারেনি কেউ ওই কারণেই...
আমি
নির্বাক। চোখ বুজে নড়বড়ে ইজিচেয়ারটায় শুয়ে রয়েছে ম্যানড্রেক। জানাডুর ঘরে এই
মুহূর্তে দেওয়াল ঘড়িটার একঘেয়ে টিকটিক ছাড়া আর কোনও শব্দ নেই। একটা পুরনো তেপায়া টেবিল,
নড়বড়ে ইজিচেয়ারটা আর হাত-পা ছড়িয়ে ঠিক একটা মানুষের শুতে পারার মতো চৌকিটা ছাড়া আর
আসবাবও নেই ঘরে। জাদুকরের আস্তানা বলে মনে হওয়ার মতো কিছুই নয়। ঘোরানো সিঁড়ি দিয়ে দোতলায়
উঠেই বারান্দা। আর লাগোয়াই ছিরিছাঁদহীন ঘরটা। লি ফককে এত রং চড়াতে হল
কেন— বুঝতে পারছি এখন। এই মামুলি গেরস্থালির ছবি দেখিয়ে লোকটাকে বিশ্বসেরা জাদুকর বললে
স্রেফ হাসত পশ্চিমের মানুষ।
বোধহয়
আমার মনের কথাটাই আবার পড়ে ফেলল ম্যানড্রেক। একই ভঙ্গিমায় শুয়ে শুয়েই বলে উঠল,
পশ্চিমি ভোগবাদ নিয়ে বলতে দিলে এখনই যে থিসিস নামিয়ে দিতে পারবে একটা, জানি।
স্ট্রাগল খুব প্রিয় শব্দ তোমাদের। মুশকিলটা কোথায় জানো? আসলে স্ট্রাগল হল পথটা।
লক্ষ্যটা হল উন্নতি। কিন্তু তোমাদের হাবেভাবে মনে হয় আসলে স্ট্রাগলটাই লক্ষ্য
তোমাদের। তাই মানিক বাঁড়ুজ্জের মৃত্যুটাও যেন গৌরবের তোমাদের চোখে। লজ্জার নয়...
আমি
নিরুত্তর। কিছু ভাবতেও ভয় করছে এখন। সোহিনীর সামনে সেদিন নির্বস্ত্র
আমার হাতজোড় করে দাঁড়িয়ে থাকার অস্বস্তিকর মুহূর্তটাকে ভাবলেও এই মুহূর্তে ঠিক
জেনে ফেলবে এই ভয়ংকর লোকটা। তারিয়ে তারিয়ে হাসছিল সোহিনী। আমার গলায় জড়িয়ে দিয়েছিল
ওদের পোষা কুকুরের শেকলটা। আর পুরুষ হয়েও সেই মুহূর্তে
পাতালে ঢুকে পড়তে ইচ্ছা করছিল আমার। কথাটা মাথায় আসতেই মনে হল, পুরো ব্যাপারটা
এক্ষুনি জেনে ফেললও বোধহয় লোকটা। বিশ্রী চিন্তাটা প্রাণপণে মাথা থেকে সরানোর
চেষ্টা করতে করতেই আবার শুনতে পেলাম ম্যানড্রেকের গলা, আসলে কি জানো, আর পাঁচটা
পেশাদার জাদুকরের থেকে জাদুবিদ্যার তাৎপর্য আমার কাছে বরাবরই একটু আলাদা। ম্যাজিক
আমার কাছে যতটা বিনোদন, তার থেকে অনেক বেশি করে দুষ্টের দমন আর শিষ্টের পালন। সেই
জায়গা থেকেই সময় দিচ্ছিলাম তখন মেয়েটাকে। এটা তো ঠিকই, ট্রেন-বাসের ভিড়ে অনেকরকম
খারাপ অভিজ্ঞতারই মুখে পড়তে হয় মেয়েদের। ওর প্রাথমিক রাগটা তাই ছিল একদমই
স্বাভাবিক। কিন্তু যখন বুঝলাম, সব বুঝেও আসলে মচকাবে না ও, মেয়ে হওয়ার সুযোগ নিয়ে
চেষ্টা করবে তর্কে জেতার...
একটানা
বলতে বলতে অল্প বিরতি নেয় ম্যানড্রেক। আবার শুরু করে, আসলে কী জানো, ভুল আমরা সবাই
করি। কিন্তু বোকা আমরা কেউই নই। নিজের ভুল টের পেতেও সময় লাগে না
আমাদের। কিন্তু স্বীকার করে মিটমাট করে নেওয়া সচরাচর ধাতে নেই আমাদের। তর্কে জেতার
মোহ আসলে অতি সাংঘাতিক এক নেশা আমাদের। তাই নিজের ভুল টের পেয়েও যারা সমানে
অযৌক্তিক কথা বলে যায়, যুক্তির বাইরের সেই ঘটনাগুলোকেই তখন তাদের চোখের সামনে
ঘটিয়ে দেখাই আমি...
ঠিক
ঠিক, বলি আমি, হাততালি দিলাম বন্ধু। কিন্তু আরও একটা প্রশ্ন ছিল...
মনে
আছে, হাত তুলে আমায় থামিয়ে দেয় ম্যানড্রেক, আমি ভগবান নই বন্ধু। তাই সবেতে নাক
গলানোর দায়ও আমার নেই। শুধু চোখের সামনে অন্যায় ঘটতে দেখলে কিছু, তখনই মাথা ঘামাই।
ট্রেন আটকানো উচিত নাকি সেটা তো অন্য প্রশ্ন। হতেই পারে কিছু যুক্তি ছিল ওই
লোকগুলোরও। আর সরকার কেন নিষিদ্ধ করছে না বনধ-অবরোধ? তবে হ্যাঁ, ওই ভিড়ে যদি কারও
জীবনমরণের প্রশ্ন উঠে যেত, তখন অবশ্যই...
কথাটা
অসমাপ্ত রেখেই এতক্ষণে চোখ খুলে তাকায় ম্যানড্রেক।
ভাবতে
থাকি মুহূর্তের ওই চিনচিনে অনুভূতিটাতেই কি তবে সূচনা হচ্ছিল সম্মোহনের? বুঝতে
পেরেই চোখ বন্ধ করে নিয়েছিল ম্যানড্রেক? কিন্তু যে ভয়ানক ক্ষমতা আছে তার, ভগবান না
হয়েও পালটে দিতে পারে অনেক হিসেবই।
রবীন্দ্রনাথ
আর ধর্মের গোঁড়ামি, আচমকা বলে ওঠে ম্যানড্রেক, এই ব্যাপারটা নিয়ে তোমার কী মতামত?
আচমকা
এমন বেখাপ্পা প্রশ্নটার জন্য তৈরি ছিলাম না মোটে। হাঁ করে তাকিয়ে থাকি। ম্যানড্রেকের ঠোঁটের
কোণে মৃদু হাসি। বোধহয় সময় দিচ্ছে আমাকে। বলি, যে দুটো জিনিসের নাম করলে, মানে,
ঠিক মেশানোই তো গেল না। যদি কিছু সম্পর্ক থাকেই এদের মধ্যে তবে তা হল আপাদমস্তক
বিরোধিতার।
বেশ,
ইজিচেয়ার থেকে উঠে খানিক পায়চারি করে নেয় ম্যানড্রেক। তারপর হঠাৎই দাঁড়িয়ে পড়ে
সোজাসুজি তাকায় আমার দিকে। কিন্তু পরক্ষণেই বোধহয় মনে পড়ে যায় কিছু। বারান্দার
দিকে চোখ সরিয়ে নিয়ে আগের কথা রেশ টেনে আবার শুরু করে, আচ্ছা, তিনি যখন বিয়ে
দিচ্ছেন নিজের কন্যাদের, তার আগে পাত্রদের ব্রাহ্মধর্মে দীক্ষা নেওয়াতেন কেন বলতে
পারো? বলতে পারো উপনয়নের মতো প্রথায় কেন বিশ্বাস ছিল তাঁর?
সেই
মুহূর্তে ইচ্ছে করছিল আমার— প্রতিবাদ করি ম্যানড্রেকের কথায়। শুধু খুঁজে পাচ্ছিলাম
না কোনও যুতসই জবাব। অস্থির লাগছিল মনে মনে।
ম্যানড্রেক
বলে যায়, আরও আছে। বলতে পারবে, ব্রহ্মবান্ধব উপাধ্যায়কে কেন ছাড়তে হয়েছিল ব্রহ্মচর্যাশ্রম?
খ্রিস্টধর্ম প্রচারের উদ্দেশ্য যে ছিল ওই মানুষটার, এটা কি তোমার মনে হয়?
হতাশ
হয়ে মাথা নামিয়ে নিই আমি।
জানো
তো এই প্রশ্নগুলো করেছি অনেককে...
চোখ
তুলে তাকাই আমি। তাকাতেই হয়। এই প্রথম ম্যানড্রেকের গলা শুনে যেন মনে হয় আমার—
সেখানে আছে হতাশা। ইতিমধ্যে কমে এসেছে দিনের আলো। জানাডুর ঘরের মধ্যে এখন আবছায়া।
আসন্ন অন্ধকারটার দিকে তাকিয়ে তাকিয়ে বলে চলে ম্যানড্রেক, এবং সেদিনও ভেলকি
দেখানোর কোনও ইচ্ছাই ছিল না আমার। উত্তরগুলোই খুঁজছিলাম আসলে। কিন্তু প্রশ্নগুলো
শুনেই রেগে উঠল লোকজন...
কাদের
কথা বলছ?
গিয়েছিলাম
সেবার কলকাতার একটা সাহিত্যসভায়। প্রশ্নগুলো করেছিলাম, যেহেতু ছিলেন অনেক দিগ্গজ
মানুষ। কিন্তু দেখলাম চটে উঠলেন অনেকেই। একটা লোককে নিয়ে তো পড়ে গেলাম খুব বিপদে।
দুটো বাজে কথা তাও সয়ে নেওয়া যায় চুপচাপ। কিন্তু টের পাচ্ছিলাম, শো-কেসের মাথায়
রাখা ফুলদানিটা আমার মাথায় ঝাড়ার কথা ভাবছিল ব্যাটা।
মদ
খেয়েছিল বুঝি মাল?
তা
টেনেছিল দু’ পেগ। কিন্তু সেটাই বড় কথা নয়। আসলে সমস্যা ছিল ব্যাটার। অত খারাপও নয়
মোটেই। তাহলে আসত না ওই সভায়। আসলে ঝোঁকের মাথায় হাত চালিয়ে দেওয়ার স্বভাব আছে...
মনে
হয় বুঝতে পারছি...
তুমি
চেনো। যাক, ঝোঁকের মাথায় খুনোখুনিও করে ফেলতে পারে কিন্তু ও। সাবধানে থেকো। তা বাধ্য
হয়েই সেদিন দেখাতে হল বিদ্যেটা।
তারপর...
তারপর
আর কী! কেঁচো হয়ে বসে পড়ল তোমাদের চক্কোত্তি...
জানাডু
এই মুহূর্তে অন্ধকার। সম্ভবত কাজ করবে না এখন সম্মোহন। আমার দিকে তাকিয়ে কথা শেষ
করে ম্যানড্রেক, তোমার কাছেও চাইছিলাম উত্তরগুলোই। তোমাকে আমার দলে নিয়ে আসার উদ্দেশ্য
ছিল না মোটেও। যাই হোক, হয়তো কোনওদিন দিতে পারবে কেউ উত্তরগুলো।
শুনতে
শুনতে তাক লেগে গিয়েছিল আমার। ঘরের আলোটা জ্বেলে দেয় ম্যানড্রেক। আমি হেসে বলি,
রাজনীতিতে নেমে পড়ো। অনেককিছু করতে পারবে। বিশেষ করে সম্মোহন অস্ত্রটা আছে
যেখানে...
হাত
দুটো জোড়া করে হেসে বলে ম্যানড্রেক, নমস্কার। ওই যে বললাম, সর্বশক্তিমান হওয়ার সাধ
নেই। তবে ওদের সঙ্গেও খটাখটি যে হয়নি এমন নয়।
বলো
কী?
একদম।
আর বুঝতেই পারছ, ওই লোকগুলো একেবারে অন্যরকম। রবীন্দ্রভক্তদের মতো সাময়িক
উত্তেজনায় রেগে উঠে আবার ঠান্ডা হয়ে যাওয়ার মানুষ নয়। সাংঘাতিক...
তা
তো বটেই। তা হয়েছিল কী?
সেই
একটা কথা থেকে তর্কাতর্কি। আমায় বলল, হ্যাঁ বা না-তে উত্তর
দিবি যা জিজ্ঞাসা করব। বললাম, বেশ। তাই হবে। জিজ্ঞাসা করল, এককালে উঁচু জাতের
লোকেরা নীচু জাতের ওপর অত্যাচার করেছে কিনা? বললাম, হ্যাঁ। করেছে তো। বলল, ব্যাস,
তাহলে আর কথা বলবি না। আজকের দিনে সংরক্ষণ কেন দরকার বুঝছিস তো?
তুমি
তাতে কী বললে? ভেলকি দেখালে?
প্রথমেই
নয়। বললাম, আমিও একটা প্রশ্ন করব। হ্যাঁ বা না-তে জবাব দাও। বলল, কর। বললাম, একদিন
অনেক মন্দির ভাঙা হয়েছে কিনা বলো এদেশে? বলল, হ্যাঁ, হয়েছে। আমি বললাম, তাহলে কি
আজ মসজিদ ভাঙাকেও সমর্থন করছ তুমি? এভাবে কি ইতিহাসের প্রায়শ্চিত্ত করা যায়? আর তা
যদি না যায়, তবে কোথায় কোথায় ইতিহাসকে মনে রাখব, কোথায় কোথায় ভুলে যাব? ব্যাস,
তারপরই যা হতে যাচ্ছিল, ভেলকি ছাড়া আর কিছুই করার ছিল না তখন...
ম্যানড্রেকের
এই কথার পরে যদি চমকে না উঠতাম তবে বাঙালি লেখকই নই আমি।
আমার
চোখের দিকে তাকিয়ে এবার বলে ওঠে ম্যানড্রেক, তবে, সবচেয়ে বড় ঘটনাটা ঘটানোই হয়নি
আজকের আগে অবধি...
সেই
দৃষ্টির দিকে তাকিয়ে হঠাৎ কেঁপে উঠলাম ভেতরে ভেতরে। বাইরে অন্ধকার। হালকা একটা
আলোর রেখা এসে পড়েছে শূন্যে ঝুলন্ত বারান্দাটায়। বোধহয় ধারেকাছেই আছে লাইটপোস্ট।
তখনই টের পেলাম, খুব বড় বোকামি করে বসে আছি একটা। নির্বোধের মতো কাজ করেছি এই
লোকটার পিছু নিয়ে। নিশ্চিন্তে এর ডেরায় বসে থেকে। উপরন্তু এতটাই বেহুঁশ ছিলাম
খেয়ালও করা হয়নি তখন হেঁটে আসা অলিগলি। এখনই পালিয়ে যেতে পারলেও এই ঘর থেকে—
একা-একা স্টেশনে ফিরে যাওয়া আমার কর্ম নয়। উপরন্তু এই লোকের ফাঁদ কেটে পালানোও
মুখের কথা নয়। কথা বলার যন্ত্রটা যদিও আছে পকেটে। কিন্তু খোদ রিভলভারও কিছুই নয় এই
লোকের সামনে।
আলোটাই
বা জ্বালল কেন এখন লোকটা?
শুধু
সন্ধ্যা নেমেছে বলেই?
নাকি...
গম্ভীর
গলায় বলল এবার লোকটা, মনে আছে আজকের তারিখটা?
গলা
শুকিয়ে কাঠ আমার। নীরবে মাথা নাড়াই দু’দিকে।
চৌঠা
অগাস্ট।
ঠিক।
চৌঠা অগাস্টই তো। ভুলে গিয়েছিলাম বেমালুম। কিন্তু কী হবে আজকের তারিখে?
ওরা
আসবে। রাতে। চৌঠা অগাস্ট রাতেই আসে ওরা।
কারা?
এতক্ষণে
একটা ফ্যাসফ্যাসে শব্দ বেরল গলা দিয়ে। নিজেই কানেই কিম্ভুত শোনাল নিজের গলা।
ওরা।
হানাদার। লুসিফারের লোকজন।
লুসিফারের
লোকজন?
হ্যাঁ,
চৌঠা অগাস্ট রাতেই ওদের আসার তিথি। অথবা পরের দিন পড়ে গেছে ততক্ষণে ক্যালেন্ডারে
বলতেও পারো।
লুসিফার...
পরিচয়
দিতে ঘেন্না হয়। আমারই সৎভাই। কিন্তু চিরকালের শত্রু।
হ্যাঁ
হ্যাঁ। মনে পড়ছে তো। লুসিফার। কিন্তু কারা তার লোকজন?
সারা
পৃথিবীতে ছেয়ে আছে। ধরো ট্রেনের সেই মেয়েটা, গালাগালি করা লোকগুলো বা তোমাদের
চক্কোত্তি। সবাই কমবেশি লুসিফারের লোক। নিজেরাই জানে না। আরও আছে। সেভাবে দেখলে
তোমার বা আমার মধ্যেও আছে ওর অল্পস্বল্প বদপ্রভাব। কিন্তু আজ রাতে যারা আসছে তারা
একেবারে অন্য জিনিস...
কিন্তু
কেন আসছে সেটা তো বলবে!
সময়
হলে নিজেই টের পেয়ে যাবে। এসেই যখন পড়েছ জানাডুতে ম্যানড্রেকের পিছু নিয়ে তখন
থেকেই যাও না আজকের রাতটা...
অনেক কণ্ঠের একটা মিলিত শোরগোলে
ছুটে গেল তন্দ্রাটুকু।
বসে বসে লেগে এসেছিল
চোখদুটো।
চমকে তাকালাম হাতঘড়িটার
দিকে। দুটো কাঁটা একই বিন্দুতে মেলার তোড়জোড় করছে।
বসেছিলাম জানাডুর অন্য একটা
ঘরের জানলায়। অনেক আগেই যাবতীয় আলো নিভিয়ে দিয়েছে ম্যানড্রেক। সময় দেখতে কবজিতে
তাই বেঁধেই রেখেছিলাম ঘড়িটাকে। বারোটার আগে কিছু হওয়ার আশা যে কম
বলেইছিল ম্যানড্রেক। কিন্তু হাজার অনুরোধেও ভাঙেনি কী ঘটতে চলেছে সে বিষয়ে কিছু। একবার মনে হয়েছিল আমার—
তবে কি ঘটবে ভয়ংকর কিছু?
তাকিয়ে দেখি জানাডুর
সামনে একরাশ জনতা। অথবা শুধু জানাডুই বলি কেন, গলির শেষ সীমা অবধি যতদূর চোখ চলে
শুধুই মানুষের মাথা। লাইটপোস্টের আলোয় গিজগিজ করছে মানুষ সরু গলিটার ভেতর। শরীরের
ভাষায় ক্ষিপ্ততা। ওরাই তাহলে লুসিফারের লোকজন! কিন্তু কি চায় ওরা?
ওরা চায় ম্যানড্রেকের
কাটা মুণ্ডু। এই মাথাটাকে আর এই ধড়টার ওপরে পছন্দ নয় ওদের। তাই এসেছে চৌঠা অগাস্ট
তিথিতে রাত বারোটার ঠিক আগে আগে...
চমকে পিছন ফিরলাম। কখন যে
এসে দাঁড়িয়েছে ম্যানড্রেক— টের পাইনি। অন্ধকারে মুখ দেখতে না পেলেও টের পেলাম
আশ্চর্য এক প্রশান্তি ম্যানড্রেকের কণ্ঠস্বরে। লাইটপোস্টের আলো ঢোকে না
এই ঘরে।
আবার একটা হল্লায় চমকে
তাকালাম জানলার বাইরে।
এ কী!
আতঙ্কে চুল খাড়া হয়ে উঠল
এবার। ঘোরানো সিঁড়ি দিয়ে স্রোতের মতো জানাডুতে উঠে আসছে
লুসিফারের লোকজন।
মুখে স্লোগানের ধাঁচে
অজস্র জান্তব উল্লাস।
নারীবিদ্বেষী
ম্যানড্রেকের মুড়ো ধড় থেকে নামানো চাই...
রবীন্দ্রবিরোধী
ম্যানড্রেকের লাশ গড়ের মাঠে ফেলতে হবে ফেলতে হবে...
স্ট্রাগলের শ্রেণিশত্রু
ম্যানড্রেক নিপাত যাও নিপাত যাও...
প্রতিক্রিয়াশীল
ম্যানড্রেক তোমার পশুর মতো নিধন চাই...
ঘুরে তাকাই ম্যানড্রেকের
দিকে। অন্ধকারেও বুঝতে পারি তার কোনও বিকার নেই। এবার হাত-পা কাঁপছে আমার। এখনও
কেন আলো জ্বালছে না ম্যানড্রেক! কোন সর্বনাশের প্রতীক্ষা করে আছে সে! জানাডুর
বারান্দায় হাজার পায়ের দাপাদাপি। চিৎকার এসে পড়ল পাশের ঘরে। যে কোনও মুহূর্তে এই
ঘরে এসে ঢুকবে লুসিফারের লোকজন। এখনই যদি জ্বলে না ওঠে আলো— ম্যানড্রেকের এরপরের
পরিণতিটুকু বেশ টের পাচ্ছি আমি। শিউরে উঠছে শরীর। আজ রাতেই ওরা তুলে নিয়ে যাবে
ম্যানড্রেককে। সাতচল্লিশ বছর কেটে গেলেও তারপর নিখোঁজই হয়ে থাকবে ম্যানড্রেক।
নিঃসীম আতঙ্কে আর্তনাদ করে উঠতে গেলাম আমি...
ঠিক সেই মুহূর্তেই দরজা
ঠেলে এই ঘরে ঢুকে পড়ল একরাশ ক্ষুধার্ত হায়না।
পরক্ষণেই দপ করে জ্বলে
উঠল আলো।
কিন্তু এ তো বৈদ্যুতিক
বাতির আলো নয়! খুব উজ্জ্বল একটা আলো...
একঝলক তাকিয়েই আর্তনাদ
করে উঠলাম আমি। ম্যানড্রেকের হাতে একটা চৌকো স্ফটিক। না, ঠিক ম্যানড্রেকের হাতে
বলা যায় না। আমি দেখলাম স্ফটিক কিউবটা হাতে নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে একটা কবন্ধ। আর
ম্যানড্রেকের কাটা মুণ্ডুটা সেই কিউবের ভেতর নাচানাচি শুরু করেছে প্রবল উল্লাসে। অত্যুজ্জ্বল
আলোটা নির্গত হচ্ছে এই মুহূর্তে কিউবটা থেকেই।
ছুটে আসতে গিয়ে থমকে
দাঁড়িয়েছে লুসিফারের লোকজন। চোখেমুখে আতঙ্ক ওদের। কিউবটা হাতে নিয়ে কবন্ধটা এবার
এগিয়ে যাচ্ছে ওদের দিকেই।
নিঃসীম আতঙ্কে চোখ বুজে
এবার চৌকাঠের ওপরেই ঢলে পড়ল দু’-একজন। বাকিদের মধ্যে লেগে গিয়েছে হুড়োহুড়ি এই
ভূতুড়ে কাণ্ড দেখে। কবন্ধটাকে এগিয়ে যেতে দেখে পিছু হটছে এবার জনতা। কিউব হাতে ঘর থেকে বেরিয়ে
গেল এবার কবন্ধটা।
জানলায় চোখ এখন আমার।
দেখতে পাচ্ছি পাক খাওয়া সিঁড়ি দিয়ে স্রোতের মতো নামতে গিয়ে ঠেলাঠেলিতে হুড়মুড়িয়ে
ছিটকে পড়ছে কেউ কেউ একতলায়। মুখ থুবড়ে পড়ে যাচ্ছে সিঁড়িতেই লোকজন। একটু আগের কমরেডদের পায়ে
মাড়িয়েই দৌড়ে নেমে যাচ্ছে জনতা। ফাটছে লুসিফারের লোকজনের মাথা। ভাঙছে কোমর। নীচের
সংকীর্ণ গলিতেও এখন লক্ষ লোকের ঠেলাঠেলি। ধাক্কাধাক্কি।
কবন্ধটার ভয়ে বোধহয়
একরাতের মধ্যেই শেষ হয়ে যাবে লুসিফারের লোকজন।
অদ্ভুত ট্রীটমেণ্ট গোটা গল্পটার। লুসিফার আর ম্যানড্রেকের মধ্যে আসলে যে কে 'হিরো' এই প্রশ্নটা থেকেই যাবে। স্টিরিওটাইপ এবং অবস্থান প্রকাশের স্বাধীনতা... স্ববিরোধী ব্যাপার। দারুণ লাগল এই উপস্থাপনা।
ReplyDeleteম্যানড্রেকের মাথার দাবী নিয়ে যারা আসছে, ম্যানড্রেক নিজেই নিজের মাথা সরিয়ে কবন্ধ হয়ে এগিয়ে যাচ্ছে তাদের দিকে। মব পিছিয়ে যাচ্ছে। লুসিফার নিজে না থেকেও তার উপস্থিতি উজ্জ্বল (কিংবা অন্ধকারময়)। এরকম আর একটা গল্প হ'তে পারে যেখানে লুসিফার মিসআণ্ডারস্টুড। তার তৈরী সিস্টেম, তার হাতের বাইরে চলে গেছে।
হতেই পারে তেমন গল্প। হয়তো অন্য কেউ খুঁজবে তার জন্য কোনও নতুন ট্রিটমেন্ট।
Deleteঅনেক দিন মনে থাকবে গল্পটা...
ReplyDeleteএই মূহুর্তে এই গল্পটার খুব দরকার ছিল কন্ট্রাডিকসন চিহ্নিত করতে। উল্লেখ্য সত্য প্রশ্নগুলোর জবাব সিস্টেম দিতে পারেনা কোনোদিনই। লেখক আবেশ কুমার দাসকে সাবাসি দিই। ----নীতা বিশ্বাস
ReplyDeleteসুন্দর গল্প
ReplyDeleteদুর্দান্ত একটা গল্প পড়লাম।
ReplyDelete