।। বাক্ ১৩৪ ।। সম্পাদকীয় ।।




সম্পাদকীয়

।। বাংলা কবিতার প্রথম ব্লগজিন ‘বাক্‌’-এর এই সংখ্যা ছোটগল্পে নিবেদিত হচ্ছে। আমরা চাইছি, এই সময়ের উপযুক্ত গল্প কিছু ছাপতে। শুধুমাত্র শৈলীর জোরে, বা ফর্মের কারসাজিতে গল্প লেখার দিন শেষ হয়ে গেছে, এই আমাদের বিশ্বাস। ওটা বিংশ শতাব্দীতে চলত, তখন জীবন অনেক একমাত্রিক ও বাস্তবিক ছিল, এবং সেই একমাত্রিক বাস্তবিক জীবনের রহস্যকে ফুটিয়ে তুলতে বহুমাত্রিক ফর্মের দরকার হত। তখন প্রয়োজন ছিল 'ফিনিগ্যান্স ওয়েক' বা 'অন্তর্জলী যাত্রা' বা 'চাঁদের অমাবস্যা'-র বিষয়ের চেয়ে ফর্মের উত্তরাধিকার ধারণ। আজ জীবন স্বয়ং এতই কাল্পনিক অলিখিত-প্রায় আর অবিশ্বাস্য হয়ে উঠেছে যে সাহিত্য খুব সহজভাবে তাকে ফুটিয়ে তুললেই সততার প্রশ্নে খাঁটি থাকবে। সেক্ষেত্রে সিউডো-ইন্টেলেকচ্যুয়ালদের খপ্পর থেকে মুক্তি পাবে বাংলা সাহিত্য, আবার, একই সঙ্গে, বাজারি মধ্যমেধার হাত থেকেও মিলবে রেহাই। মধ্যমেধা বা ছদ্ম-ইন্টেলেকচ্যুয়ালদের চিনবেন কী করে? কয়েকটা সাধারণ লক্ষণ আছে- ১। এঁরা নিজেদের কোনো কথা বলেন না। জ্ঞাতসারে বা অজ্ঞাতসারে সেটাই বলেন যেটা চমকপ্রদ, কিন্তু অনেক আগেই বলা হয়ে গেছে। ২। এঁরা আত্মবিশ্বাসহীনতায় ভোগেন। কোনো কথা বলার আগে বা পরে এঁরা একজন প্রতিষ্ঠিত ব্যক্তির রেফারেন্স টানেন। যেমন এঁরা হয়ত বললেন, “রুইমাছের কালিয়াটায় ঝাল বেশি হয়েছে”, সেটার আগে বা পরে এঁরা জুড়ে দেবেন, “জামাইবাবু যেমন বলেছিলেন। ৩। এঁরা সচরাচর দাড়ি রাখেন, যেমন অনুপম মুখোপাধ্যায় এমনিতে ক্লিন শেভন হলেও তার প্রোফাইল পিকচারে দাড়ি আছে। ৪। এঁরা একটা বইয়ের দুটো লাইন পড়েই সেটাকে নিয়ে দু-পাতা লিখে ফেলতে পারেন। পলিটিকালি এঁরা প্রগতিপন্থী, যদিও যে কোনো উন্নতিকেই সন্দেহের ও সংকটের চোখে দেখেন। সমাজ বিপন্ন হলে এঁদের স্ট্যাটাস দেওয়ার সুবিধে হয়। ৫। এঁরা যখন কোনো সমবয়সী বা অপ্রতিষ্ঠিত লেখকের কথাবার্তা ব্যবহার করেন, ঋণস্বীকার করেন না, মনে-মনে নিজেকে অপ্রতিদ্বন্দ্বী ভাবেন, অথচ শ্রেষ্ঠত্বের দাবি করেন না। ৬। কিছু বিখ্যাত নাম এঁরা কথায় কথায় বলেন, কিন্তু এঁদেরই কথানুসারে খ্যাতি এক বিষাক্ত ব্যাপার। সেলিব্রিটি বা সাহিত্যগুরুদের লেগাসি সোচ্চারে ঘোষণা করেন। নিজের লেগাসি তৈরির দিকে যাওয়ার আস্থা নিজের প্রতি নেই। ৭। বিষয়ের চেয়েও এঁরা স্টাইলকে গুরুত্ব দ্যান। বলার কিছু নেই, কিন্তু বলার কায়দাটা রপ্ত করেছেন। ৮এঁরা বিপজ্জনক নন। কিন্তু নিম্নমেধার সবজান্তা পাঠকরা এঁদের গুরুত্ব দিয়ে একটা ঘোলাটে পরিবেশ তৈরি করে, সেটায় বিপদের আভাস থাকে। আমরা সত্যিই বিশ্বাস করি সাহিত্যের অগ্রগতি সাহিত্যিকের মেধায় হয় না, মেধার প্রশ্নটা পাঠকের ক্ষেত্রেই থাকে। আমরা মনে করি সাহিত্যের অগ্রগতি এবং সাহিত্যের বিস্তার দুটি ভিন্ন বিষয় নয়। ভিন্ন হলে যে বিপদ ঘটতে পারে, সেটাই আজ ঘটছে। আমাদের সাধ্য নেই সেই বিপদ থেকে বাংলাসাহিত্যকে মুক্তি দেওয়ার। আমরা ক্ষুদ্র পরিসরে কিছু খাঁটি লেখা পেশ করছি মাত্র।।
                                                  অনুপম মুখোপাধ্যায়
                                            পরিচালক : বাক্