।। বাক্ ১৩৪ ।। গল্পসংখ্যা ।। জয়দীপ চট্টোপাধ্যায় ।।







সূর্য শিশির


- এখানে কী করিস?
- পাম্প দিই।
- কোথায়?
- কোথায় দেয়?
- দেখবি কোথায় দেয়?

উঠে ছেলেটার দিকে এক পা এগোতেই পাশের লোকটা হাত টেনে ধরে বলল, "আহ... কেন ফালতু ওর পেছনে লাগছিস? ছাড় না!" "আরে জানিস না বাঁড়া... দেড় হাত ছেলের দু হাত ধোন।" ছেলেটা দূরে সরে গিয়ে টায়ারগুলো জল দিয়ে ধুতে বসল। ইচ্ছে করেই এই বেঞ্চের দিকে মুখ করে বসল না। সেদিকে তাকিয়ে 'দেখিয়ে দিতে চাওয়া' যুবকটি আবার জিজ্ঞেস করল, "সাধনদার দোকানের কাজটা ছাড়লি কেন?" ছেলেটা কোনও উত্তর দিলো না। আবার জিজ্ঞেস করল, "কী রে? ছাড়লি? না ফুটিয়ে দিলো?" 
- ছেড়ে দিলাম।
- কেন বে? মাইনে-ফাইনে দিতো না... না কী?
ছেলেটা উঠে দোকানের ভেতরে চলে গেল ভিজে টায়ারগুলো নিয়ে। কিছুক্ষণ পর বেরিয়ে এসে একটা ছেঁড়া জুটের কাপড় দিয়ে একটা সাইকেলের স্পোক মুছতে বসল। বাইরে যুবক দু'জন বাইকে উঠে বসল, স্টার্ট দিয়ে সামনে বসে থাকা যুবকটি বলল "অল্প বয়সে অত পোঁদ পাকানো ভাল না, বুয়েচিস তো? পেছনে ঢুকবে... টের পাবি তখন!" দেখে মনেই হ'ল না ছেলেটার কিছু হ'ল। বাইক চলে গেল, বাইকের শব্দও ক্ষীণ হয়ে মিলিয়ে গেল। তারপর একজন মাঝবয়সী ভদ্রলোক মাথা তুলে জিজ্ঞেস করলেন "দেরি হবে?" ইনি এতক্ষণ মাথা নামিয়েই ছিলেন... মাটির দিকে তাকিয়ে, নিজের চটির দিকে তাকিয়ে, ঘড়ির দিকে তাকিয়ে, মোবাইল ফোনের দিকে তাকিয়ে। অল্পবয়সী ছেলেগুলো বাইকে করে এলে মাঝে মাঝে এই ভাবে মাথাটা নিচু হয়ে যায়। ওটাই তখন একরকম রিফিউজ। চোখাচুখি হয়ে গেলে কী কথার উত্তরে কী বলে ফেলবেন মুখ ফসকে। চোখাচুখি না হলে অনেক কিছুই এড়িয়ে যাওয়া যায়। ছেলে দুটো যেতে যেন হাঁফ ছেড়ে বাঁচলেন কান্তিবাবু। মাথা তুলে সামনের ছেলেটার দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করলেন - "দেরি হবে?" ছেলেটাকে দেখলে মনে হয় না চোদ্দ-পনেরো বছরের বেশি বলে। হালকা গোঁফের রেখা বেরিয়েছে। রোগাটে হলেও শক্ত পরিশ্রমী চেহারা। জুটের ন্যাকড়াটা পাশে রেখে উঠে দাঁড়িয়ে বলল, "আপনি ঘুরে আসুন। ঘণ্টা খানেক লাগবে। বসে থেকে লাভ নেই। সুনীলদা ফিরুক।" "ঘণ্টা খানেক?" কথাটা অস্ফুটে বলতেই ছেলেটা বলল "তাহ'লে বসে থাকুন... দেখছেন তো আর কেউ নেই। আমি একা।" অল্পবয়সী হলেও ছেলেটার কথাবার্তা কেমন রূঢ়, অসহিষ্ণু। কান্তিবাবু আজকাল বেশির ভাগ অল্পবয়সী ছেলেদের কথাবার্তার মধ্যেই এমন অধৈর্য ভাব অথবা অসহিষ্ণুতা লক্ষ্য করেন। উঠে দাঁড়িয়ে একবার জিজ্ঞেস করলেন "আজকের মধ্যে হবে তো?" ছেলেটা রেঞ্চ বাছতে বাছতে বলল "জানি না!"। কী স্পষ্ট, ধারালো "জানি না"! ওই বাইকে আসা ছেলেদুটোকে এই ভাবে উত্তর দিলে ঘা-কতক লাগিয়ে দিতো। কান্তিবাবু শুধু বললেন 'ঠিক আছে তাহলে।', তারপর আসতে আসতে হেঁটে চলে গেলেন দোকান থেকে দূরে। ছেলেটির বিরক্তি ভরা মুখের দিকে তাকাতে ইচ্ছে করল না। মনে হ'ল রেঞ্চ-এ চাপ দিয়ে নাট খুলতে খুলতে বাচ্চা ছেলেটা আসলে ওই বাইকে চড়ে আসা ছেলেদুটোকে খিস্তি করে যাচ্ছে। সেই গরম জিভের তাপ এসে লাগবে ওঁর নিজের মুখের ওপর। 
স্কুটারটা হঠাৎ করেই বিগড়ে গেল। কী যে হ'ল, আর কত টাকার ধাক্কা... সুনীল এলে তবেই বোঝা যাবে। সুনীল এই দোকানের আসল মেকানিক, মালিকও বলা যায়... সে নেই বলেই কাজ এগোয়েনি, ফিরে যাচ্ছেন কান্তিবাবু। ফিরে যাচ্ছেন আরও একটা দিনের ভার নিয়ে। 

--- --- ---

"ফ্যানটা চালাবে?", বলেই হাতের ব্যাগ গুলো মেঝেতে ফেলে চেয়ারে বসে পড়লেন কান্তিবাবু। জামার বোতামগুলো খুলতে খুলতে চারপাশে তাকিয়ে দেখলেন কোনও জলের বোতল ধারে কাছে নেই। পরিচিত অবসন্নতা চেয়ার থেকে উঠতে দিলো না। জিভটা মনে হ'ল শুকিয়ে যাচ্ছে। স্পষ্ট বুঝতে পারলেন, জামাটা ঘামে ভিজে সেঁটে আছে শরীরের সঙ্গে, খুলে ফেললেন গা থেকে। অথচ পাখা চালাতে কেউ এলো না। এক গ্লাস জল হাতেও কেউ এলো না ঘরে। এমন সময়ে কপালের দুপাশের রগ দপদপ করে। একটা অসহায়তা জন্মায়... আর তার থেকেই অসহিষ্ণুতা, বিরক্তি, রাগ। কোনও দিনই কি একবার চেয়ে কিছু পাওয়া যাবে না? না চেয়ে কিছু পাওয়া যাবে না? এমন অনেক কিছুই মুহূর্তের জন্য ভাবেন, তবে মুখ দিয়ে শুধু বেরিয়ে আসে " ঘরে কি কেউ নেই? একটা ফ্যান চালিয়ে দিতে পারছ না এসে?" ফ্যানের সুইচ কাছাকাছি... কিন্তু নিজেকেই শেষমেশ কাজটা করতে হবে, এই পাঁচিলটা বিশাল অন্তর সৃষ্টি করে দেয়। আঁচলে হাত মুছতে মুছতে এসে স্ত্রী মিনতিদেবী যা বলেন, তাও পরিচিত... ঠিক, এটাই বলার কথা - "ফ্যানটাও নিজে চালাতে পারছো না?" আজও তাই করলেন, কিন্ত ফ্যানটা অন করেই থমকে দাঁড়িয়ে গেলেন, "একি এত ঘামছ কেন? শরীর খারাপ লাগছে?" কান্তি বাবু বসে রইলেন চুপ করেই। কেউ শরীর খারাপ ভেবেও যদি একটু অ্যাটেনশন দেয়, সেটাও পড়ে পাওয়া চোদ্দ আনা। মিনতিদেবী নিজেই ছুটে গিয়ে জল নিয়ে এলেন গ্লাসে করে। কান্তিবাবু সেই জল থেকেই কিছুটা হাতে নিয়ে চোখে, মুখে আর দু'কানে দিলেন... তারপর বাকিটা খেয়ে নিলেন। এই ভিজে ভাবটা পাখার হাওয়ায় টেনে নিলে বড় আরাম লাগে! চেয়ার থেকে নেমে মেঝেতে পা ছড়িয়ে বসে চোখ বন্ধ করে বাঁদিকে আঙুল দেখিয়ে বললেন "বাজারের ব্যাগটা... এই নিয়ে হেঁটে ফিরতেই দেরি হয়ে গেল! সব কাজে দেরি!" মিনতিদেবী তখনও চুপচাপ কান্তিবাবুর দিকে তাকিয়ে; মধ্যবিত্ত পরিবারের গিন্নীরা যে সংশয় নিয়ে হঠাৎ অসুস্থবোধ করা স্বামীর দিকে তাকিয়ে থাকে... স্বাভাবিক হয়ে উঠছে কী না বোঝার চেষ্টা করে। 
- কী হ'ল? বাজারের ব্যাগটা নাও?
- তোমার এখন ঠিক লাগছে? আর একটু জল খাবে?
- হ্যাঁ হ্যাঁ... ও এতটা রোদের মধ্যে হেঁটে এসে...
- হেঁটে এসেছো? স্কুটার নিয়ে বেরোলে যে?
- উফ... স্কুটারটা বিগড়েই তো ফালতু ঝামেলা... চুলোর আর সময় পায় না!
-  কোথায় রাখলে? সারাতে নিয়ে গেলে হাঁটিয়ে হাঁটিয়ে?
- স্কুটারের কি পা আছে? যে হাঁটিয়ে হাঁটিয়ে নিয়ে যাব?... টেনেটুনে গেলাম সুনীলের দোকানে... সে সালাও দোকানে নেই... ফেলে রেখে এলাম!
- আচ্ছা আচ্ছা... বলছি...
- কী?
- বলছি... তুমি একবার প্রেশারটা দেখিয়ে নাও। আর সুগারটাও। অনেকদিন হয়ে গেলো...
- হ্যাঁ হ্যাঁ... সে হবে 'খন। আপাতত অফিস বেরোই। 
- স্কুটারটা যে গেল... যাবে কী করে?
- যখন স্কুটার ছিল না... তখন যেভাবে যেতাম?
- দিনদিন খিটখিট করা স্বভাবে দাঁড়িয়েছে!... 

মিনতি ওখান থেক দ্রুত চলে গেলেন ফাঁকা গ্লাসটা হাতে নিয়ে। রান্নাঘর থেকেই চিৎকার করে বললেন "প্রতিমার মা আজকে আসেনি... বাসন জমে আছে, এক থালাতেই যা আছে খেয়ে বেরোতে হবে আজ!" কান্তিবাবুও একটু গলা চড়িয়ে বললেন, "যেখানেই দাও, সময় মত দিও। এরপর হাফ ডে হয়ে যাবে!" রান্নাঘর থেকে পালটা চিৎকার ফিরে এলো। চিৎকার না বলে ঝঙ্কার বলা ভাল। থালাবাসন একসঙ্গে পড়ে গেল যেমন শব্দ হয়। "বাজার সময় মত এসেছে? তাড়া থাকলে বাইরে থেকে আনিয়ে নাও। নইলে বাইরেই খেয়ে নাও! আমি মুড়ি-জল খেয়ে চালিয়ে দেবো!" 

--- --- ---

বাসে বসার সিট পেয়েই একবার বুক পকেট থেকে ফোনটা বার করে দেখে নিলেন কান্তিবাবু। ফোনেই সময় দেখতে হবে, কারণ  তাড়াতাড়ি করতে গিয়ে হাতঘড়িটা পরতে ভুলে গেছেন। 
এই ফোনটা পুরনো, ওঁর স্ত্রী ব্যবহার করেন। ভীষণ রকম অপছন্দের জিনিস হওয়া সত্ত্বেও, ঠিক অফিস বেরনোর মুখে ওনার স্ত্রী পিছু ডাকলেন। মন কিংবা মেজাজের অবস্থা যেমনই হোক, আজ অবধি মিনতির ডাকে সাড়া না দিয়ে থাকতে পারেননি কান্তিবাবু। তাই আজও চোখে-মুখে স্পষ্ট বিরক্তি নিয়েও পেছন ফিরে তাকালেন। মিনতিদেবী হাতের ফোনটা এগিয়ে দিয়ে বললেন "মাঝে মাঝেই নিজে থেকে বন্ধ হয়ে যাচ্ছে ক'দিন ধরে। আজ সকাল থেকে এই নিয়ে তিনবার হ'ল। আমি ধরিওনি তাও...
- আজ হবে না, শনিবার সকালে মোড়ের মাথার দোকানে নিয়ে যাব... 
- না না, আজ সারাতে হবে না। 
- তাহ'লে?
- বলছি... বাবু এখনও ফোন করেনি। যদি সুইচ অফ পায়... তোমার ফোনটা আজ রেখে যাবে?
- ও জানবে কী করে যে আমার ফোন তোমার কাছে আছে? তোমার ফোনেই তো করবে। আমার কাছে থাকলেও তো বন্ধ থাকলে সেই সুইচ অফই পাবে! আশ্চর্য! 
- আমিই ফোন করে নেব। 
- আইএসডি করবে! অত ব্যালেন্স আছে?
- আচ্ছা, মিসড্‌ কল করব। বাবু ঠিক বুঝে ফোন করবে। 
কান্তিবাবু জানেন, "বাবুর জন্য মিনতি সব রকম কথা চুপচাপ মেনে নেবে... কিন্তু যা ঠিক করেছে সেটাই করবে।" কথা না বাড়িয়ে, হাত বাড়িয়ে মিনতিদেবীর ফোনটা নিয়ে নিজের ফোনটা পকেট থেকে বার করে বারান্দায় রাখা টুলের ওপর সশব্দে রেখে বেরিয়ে এলেন। গেট বন্ধ করার সময় একটা ঘটাং শব্দ করে কিছুটা বিরক্তি কমল। কিন্তু সে শব্দ আর কাউকে ছুঁলো না। ফোনটা তুলে ঠোঁট টিপে হেসে ঘরের ভেতরে চলে গেলেন মিনতিদেবী। এমন হাসির সঙ্গে দীর্ঘশ্বাসও বেরিয়ে আসে। 

ছেলেটা অন্য দেশে থাকে, টাইমজোনের অনেক তফাৎ। নিজের সময় মত ফোন করে, যখন ওখানে রাত। বোঝেন, সব সময় মিনতির ওপর রাগও করা যায় না। কিন্তু বিরক্তি জিনিসটা খুব টেঁটিয়া। জোঁকের মত ঘাড়ের কাছে চেপে বসে। সকাল সকাল স্কুটারের জন্য ভোগান্তিটা কান্তিবাবুরই হ'ল, কাজের লোক আসেনি বলে অফিসে দেরিও ওঁরই হ'ল, গরমে অস্বস্তি ওঁরই হচ্ছে। খারাপ ফোনটাও ওঁকেই সঙ্গে নিতে হ'ল। সহ্য হ'ল মধ্যবিত্তের মাথার মত, যা কাটতে কাটতে বিরক্তির কবন্ধ জন্মে যায়। আর সে কবন্ধ জেগে গেলে, আর কিছুতেই ঘুমোতে চায় না। এখন এই বাসে বসে গরমের মধ্যে এসব যত ভাববেন, তত - ঘাম হবে, গলা-জিভ শুকিয়ে আসবে, রগের শিরা দপদপ করবে। সেও নিজেকেই সহ্য করতে হবে। ব্যাগ থেকে জলের বোতলটা বার করে এক ঢোক জল খেয়ে বুঝলেন, জলেরও তাপমাত্রা বাড়ছে। তারপর অভ্যেস মত সময় দেখার জন্য, আরও একবার ফোনটা পকেট থেকে বার করলেন। 

ফোনটা বার করে দেখলেন সাড়ে এগারোটা বাজে। আর তখনই লক্ষ্য করলেন - চার্জ অর্ধেকের কম। বউয়ের ফোন এনেছেন, চার্জার তো আনেন নি !

--- --- ---

রণেন বলত, "আজ যা কিছু দেখে মনে হচ্ছে 'এ আর এমন কি ব্যাপার?'... একদিন দেখবি সেগুলোই সামলাতে সামলাতে জেরবার হয়ে যাচ্ছিস! একেই বলে বুড়ো হওয়া!" 
অফিস পৌঁছে চুপচাপ নিজের টেবিলে বসে রইলেন কান্তি বাবু। সত্যিই তো, একটা বাজতে যায়। অজুহাত না দিয়ে নিজে থেকেই হাফ-ডে নেওয়া উচিৎ। অথচ সত্যিকারের কারণ বললেও লোকজনের হাসি পায়। অল্প বয়সী ছেলে, কোয়ালিফিকেশনের ওজনে ম্যানেজার হয়ে গেছে। মুখে বাঁকা হাসি লেগেই থাকে। অথচ এগুলো ভাবলে নিজেকেই 'কমপ্লেনিং' মনে হয়। অল্পবয়স তাঁরও ছিলে এককালে, কাজে লাগাতে পারেননি। আজকাল ছেলেরা লাগাচ্ছে কাজে। লাগাতে শিখে গেছে। হিসেব করে দেখলে এখন লাঞ্চ আওয়ার। একটু পরে সোজা কেবিনে গিয়ে বলে দেবেন, আজকের জন্য হাফ-ডে লীভ ধরতে। ভাবতে ভাবতেই পকেট থেকে মোবাইল ফোনটা বার করে সময় দেখতে গিয়ে দেখলেন - মরে গেছে। মোবাইল ফোন আবার অন করতে হবে। তাতে সময় সেট করতে হবে নতুন করে। রিসেট করার মত ওইটুকুই হাতে আছে আপাতত। অবসর নিতে আর বছর চারেক... তার কাউণ্ট ডাউনটাও আজকাল মোবাইলফোনের ক্যালেণ্ডারে দেখতে পান। 

বোতল থেকে কিছুটা জল খেয়ে, কাজে মন দিলেন। কাজ করলে মন ভাল থাকে না, তবে অস্বস্তির কারণগুলো ব্যস্ততার আড়ালে চলে যায়। ঘড়িটাও যেন একটু দ্রুত হয়ে যায়। 
"এবারে একটা ফ্লোর এসির ব্যবস্থা করা দরকার। একে চারদিক বন্ধ। এই গরমে গায়ে জামা রাখা যাচ্ছে না আর!" 
আওয়াজটা পেছন দিক থেকে এলো, অনির্বাণের গলা। বছর চল্লিশ বয়স... কান্তিবাবু তুই করেই ডাকেন। সেদিকে না তাকিয়েই গলাটা তুলে বললেন "আজ কত?"
- কী কত?
- টেম্পারেচার?
- ওই আটত্রিশ-উনচল্লিশ হবে!
- আর তোর বয়স?
- ফরটি ওয়ান রানিং... কেন?
- বয়সের থেকে তাপমাত্রা বেশি না হ'লে গরমের কমপ্লেন করতে নেই! গুনাহ হয়। 
একসঙ্গে দু-তিন জন হা হা করে হেসে উঠল। কথাটা অনেকেরই কানে গেছে। এরা হয় লাঞ্চে যায়নি, নাহ'লে ফিরে এসেছে তাড়াতাড়ি। এমন থাকে দু-তিন জন। লাঞ্চ আওয়ারেও ডেস্কেই পাওয়া যায়।
"নিজে তো শেষ কবে কলারের বোতাম লাগিয়েছিলে ঠিক নেই... বারো মাস কপাল ঘামে ভিজে থাকে..." , কান্তিবাবুকে নয়, ওই হাসিগুলোকে সামলাতে উত্তর দেওয়ার চেষ্টা করছিল অনির্বাণ। জবাবে কিছু না বললে হেরে যাওয়া হয়। অফিসে প্রকাশ্যে হারতে শুরু করলে আজকাল খুব অসুবিধে। কান্তিবাবু কিছুই বললেন না, ঠোঁটে একটা মুচকি হাসি নিয়ে চশমা পরে ফাইলের দিকে তাকিয়ে রইলেন। ত্রিশ বছর আগের অফিস, আর এখনকার অফিস অনেক আলাদা। সব কিছুই ভীষন ভাবে পালটে গেছে। কোনও সিনিয়র কলীগকে মুখের ওপর উত্তর দেওয়ার মত সাহস জোটাতেই পাঁচ বছর লেগেছিল। অফিসে দু-তিনজন মহিলা সহকর্মী থাকতেন। স্টেনোগ্রাফার, ম্যানেজারের পিএ, রিসেপশনিস্ট। তাদের সঙ্গে এক-আধদিন বেশি কথা হ'লে ঠিক কেউ না কেউ সেটা নোট করে রাখত, পরে সেই নিয়ে সিনিয়রদের সামনে ভাজবে বলে। আর এখন অফিসে মহিলাকর্মীও বেড়েছে। তাদের সঙ্গে ছেলেগুলো কত কথা বলে, একসঙ্গে যাওয়া-আসা করে। খাওয়া-দাওয়া করে। এদের বাড়ির লোকেও মাথায় ঘামায় না। কে কার ঠিক কে হয়, সব সময় বুঝতেও পারেন না কান্তিবাবু। জোর করে বুঝতে চেষ্টা করলে মাথা ধরে যায়, রগের শিরা দপদপ করে। প্রতিটা কথা মেপে বলতে হয়। ভালমানুষ সেজে থাকার ব্যাপার নয়... নিজেকে বাঁচাতেই সাবধানে সামলে রাখতে হয়। কোন কথার কে কোন মানে করবে, তার ঠিক নেই। মাঝে মাঝে ভয় হয়, স্রেফ মুখের কথার জন্যেই না কোনদিন হাজতে চালান করে দেয়! 
রণেন বলত, "একসময় দেখবি সব কিছু কেমন পালটে গেছে। তুই এখন যেমন ভাবছিস, 'এগুলো একদিন থাকবে না... এসব এমন থাকবে না... তখন তুই এর থেকে ভাল থাকবি।' তখন দেখবি একেবারে অচেনা লাগবে সব কিছু, তখনকার সে'সবের মাঝেও অস্বস্তি হবে তোর। দেখবি তখন আরও অসুবিধে হচ্ছে। বিরক্ত হচ্ছিস! তখন বুঝতে পারবি... বুড়ো হয়ে যাচ্ছিস!"
জানলা বন্ধ করে দেওয়ার মত অনির্বাণ আর অন্য গলার আওয়াজগুলোর ওপর মনের পাল্লাটা বন্ধ করে দিয়ে ফাইলের পাতায় মনটা বসালেন কান্তিবাবু।  গরমে ঘাম হলে, সত্যিই বুকের বোতাম খুলেই কাজ করা অভ্যেস কান্তিবাবুর। অনির্বাণ ভুল কিছু বলেনি। কিন্তু এখন শুধু গলার নিচের একটা বোতামই খোলা রাখেন। ভেতরে একটা হাফ-হাতা সাদা গেঞ্জিও পরেন। বুকে লোম বেশি, তাও পঞ্চাশ ছোঁয়ার আগেই সব একদম সাদা হয়ে গেছে। ওনার বুকের লোম একজন অল্পবয়সী মহিলাকর্মীর অস্বস্তির কারণ হচ্ছে... এমন শুনেছিলেন। তারপর থেকেই অফিসে ঢোকার আগে গলার বোতাম ছাড়া বাকিগুলো বন্ধ করে নেন। একটা সাদা গেঞ্জিও পরেন ভেতরে। হঠাৎ সেই কথাগুলো আর সেই মেয়েটির কথা মনে পড়ে গেল। মেয়েটি কবে কী পরে আসে, আর কী দেখা যায়... সেই নিয়ে আজ যদি মুখ ফসকেও কান্তিবাবু কিছু বলে ফেলেন, তাহলে হয়ত রাজ্যের সব মানুষ তাঁর মুখটা চিনে যাবে - ফেসবুকের দৌলতে। জামার হাতায় কপালের ঘামটা মুছে দেখে নিলেন বুকের বোতামগুলো ঠিকঠাক বন্ধ কী না। দেখতে গিয়ে টের পেলেন... আজ তাড়াহুড়োর মধ্যে হাফ হাতা গেঞ্জিটা পরে আসতে ভুলে গেছেন!

--- --- ---

- এই... বিপ্লব... ফোনের চার্জার আছে?
- এইতো... নিয়ে নিন।
- না না... স্মার্টফোন না... এইরকম পিন...
- ওরে বাবা, এই জিনিসের চার্জার এখন কার কাছে থাকবে। দেখুন যদি রিসেপশন থেকে হেল্প করতে পারে। 

কান্তিবাবু এই ভয়টাই পেয়েছিলেন। ফোনে আর চার্জ নেই। আর এই ফোনের চার্জার আজকাল চাইলেই পাওয়া যায় না। আগে একটা চার্জিং-বোর্ডে তিন-চার রকম চার্জার রাখা থাকত, সকলের সুবিধের জন্য। এখন সেখানেও এই ফোনের চার্জার নেই। জনে জনে চার্জারের কথা জিজ্ঞেস করতেও ভাল লাগে না। সকালে স্কুটার দিয়ে শুরু হয়েছে, এখনও চলছে... দুর্ভোগ। রিসেপশনে গিয়ে কী বলবেন? মেয়েটি এমনিতেই সারাদিন কানে ফোন দিয়ে বসে থাকে। পিওনদের মধ্যে একজনকে ডেকে বাবা-বাছা করে যদি কিছু ম্যানেজ করা যায়। কাজের ফাঁকেই ঘাড় তুলে তুলে দেখছিলেন, যদি কাউকে যেতে-আসতে দেখা যায়। প্রশান্ত ছেলেটা ভালো, সব সময় হাসিমুখ। একটু বখশিশ দিলেই খুশি। মুখের ওপর কখনও না বলে না। অনেক কিছু শেখার আছে ছেলেটার থেকে। কান্তিবাবু নিজে কি অল্পবয়সে এই প্রশান্তর মতই ছিলেন? কিন্তু উনি তো বকশিশ পেতেন না! এইসব ভাবতে ভাবতেই চেয়ারটা ছেড়ে উঠে গিয়ে রিসেপশনের দিকে গেলেন। প্রশান্তকে ধারেকাছে দেখতে পেলেন না। রিসেপশনের মেয়েটিকে বললেন "প্রশান্তকে দেখেছো?" মেয়েটি কানের ফোনটা একহাত দিয়ে চেপে ধরে বলল "অ্যাঁ?"
- প্রশান্তকে দেখেছো? বাইরে গেছে?"
-  এক সেকণ্ড, একটু হোল্ড করো প্লিজ... কী বললেন, প্রশান্ত?
- হ্যাঁ, প্রশান্ত... পিওন। 
- সরি... আমি খেয়াল করিনি। এদিকে এসেছে বলে মনে হয় না। 
রিসেপশনের ঘড়িতে চোখ যেতে দেখলেন তখন সাড়ে তিনটে বাজে। মেয়েটি একবার জিজ্ঞেসও করল না, কেন একজন সিনিয়র মানুষ বেরিয়ে এসে প্রশান্তর খোঁজ করছেন। এইটা ভাবতেই কান্তিবাবুর রগের শিরাগুলো দপদপ করতে শুরু করল। "এ এক অদ্ভুত অবজ্ঞা, যা প্রজন্মের অস্থি-মজ্জায় ঢুকে গেছে। অসুস্থরকমের আত্মকেন্দ্রিক প্রজন্ম। অথচ হিউম্যানিটি বা এথিক্স ছাড়াও কর্মক্ষেত্রে প্রফেশনালিজম বলে একটা জিনিস থাকে। তার কথা ভেবেও একজন রিসেপশনিস্টের প্রথম কর্তব্য জানা - এই ব্যক্তি কেন এসেছেন এবং সে কী সাহায্য করতে পারে। সেই মনোভাবটাও নেই?! এতটাই হোপলেস?!" মনে মনে এমন অনেক কিছু ভাবলেন। কিন্তু মুখে কিছু বললেন না কান্তিবাবু। বলতে পারলেন না। কারণ, উনি বলতে পারেন না। রিসেপশনিস্ট ডেস্ক-এর সামনের জায়গাটিতে খানিক পায়চারি করলেন। তারপর র‍্যাক থেকে আজকের ইংরিজী সংবাদপত্রটি নিলেন। তারপর চলে এলেন নিজের জায়গায়। মেয়েটি ফোনে কথা বলতে বলতেই বলল "অজীব লোগ!... না তোমায় বলিনি!" 

--- --- ---

এখন খবরের কাগজগুলো সব রঙিন। খবরের থেকেও বেশি ছবি, রঙিন যাপনের ইস্তেহার। ক'টা পাতা উলটেই চোখে পড়ল একটা শরীর। বিদ্যুৎ-রেখার মত। বিকিনি পরে দাঁড়িয়ে আছে... উপচে পড়া, গা দিয়ে গড়িয়ে পড়া লাস্য নিয়ে। এমন চাহনি, এমন হাসি, এমন ভঙ্গি... কী করে পারে? কতগুলো ছবি নিলে তার থেকে এমন একটা বেছে নেওয়া যায়? আজকাল ইংরিজী কাগজগুলো একটু বেশিই ভাল লাগে, এমন লাস্যময়ী ছবিগুলোর জন্য। বিদেশীরা নাকি অনেক খোলামেলা, রাখঢাক কম। ন্যুডিস্ট, অ্যানার্কিস্ট... আরও কত কী আছে। এদেশে এসব বললে লাঠি-পেটা করবে। "অথচ অল্পবয়সে বাংলা সিনেমায় কারও স্লীভলেস ব্লাউজ দেখলেও বুকটা ধক করে উঠত! বাড়িতে বলা যেত না, যে এই সিনেমা হলে গিয়ে দেখে এসেছি", ভাবতে ভাবতে ফোঁস করে একটা দীর্ঘশ্বাসের সঙ্গে হাসি পালিয়ে গেল কান্তিবাবুর মুখ থেকে। কাগজটা উলটে পালটে, ক'টা হেডলাইনে চোখ বুলিয়ে আবার ফিরে এলেন সেই লাস্যময়ীর কাছে। একটা মোহাচ্ছন্ন করা হাতছানি এই ছবিটা। অনেকদিন পর কোনও ছবিতে মায়াশরীর দেখতে পেলেন কান্তিবাবু। কমলালেবুর গন্ধ, উজ্জ্বল কমলালেবুর ওপর বিন্দু বিন্দু জমে আছে ভোরের শিশির। একটার সঙ্গে একটা জুড়ে টপ টপ করে গড়িয়ে পড়ছে সোনালী রোদ মেখে। একরকম উদ্ভিদের কথা মনে পড়ে গেল - সানডিউ। একটা দ্বিতীয়মন সঙ্গে সঙ্গে সজাগ করে দিলো - 'এটা অফিস, কে কোথা থেকে দেখছে... কেউ জানে না!' তেষ্টা পেলে মানুষের চোখের দৃষ্টি পালটে যায়, দেখার চোখ থাকলে সেই দৃষ্টি দেখেই বোঝা যায়। বিশেষ করে মেয়েরা খুব তাড়াতাড়ি বুঝে নেয়। কান্তিবাবু চটপট পাতা উলটে কাগজটা ভাঁজ করে হাতে নিয়ে উঠে পড়লেন। তবে রিসেপশনের দিকে না গিয়ে চলে গেলেন জেন্টস ওয়াশরুমের দিকে। সানডিউ - এক মাংশাসী উদ্ভিদও বটে। 

ছবিটা যেন নিশির মত ডাকছে বারবার। কিন্তু ছবিই তো, এর বেশি আর কী? আগে চটি বিক্রী হ'ত... সাদাকালো ছবি। যেগুলো রঙিন, তার রঙ আর ছবির মান দুটোই অতি খারাপ। কান্তিবাবু পয়সা খরচ করে সেসব কিনতেন না, কিনত অন্য ছেলেরা... তবে সেসব হাতে নিয়ে পাতা ওলটানোর ব্যাপারটা ঠিক ম্যানেজ হয়ে যেতো। এখন সত্যিই প্রযুক্তি কত পালটে গেছে। সিডি, ডিভিডি, ওয়েবসাইট... অফুরন্ত আয়োজন। রীতিমত আন্তর্জাতিক ব্যবসা। বটতলার চটিরা টেক্কা দিতে পারবে? এই একটা দৈনিক কাগজ, সেই কীসব ছবি নামাচ্ছে... ভাবা যায়! খবরের কাগজটা হাতে নিয়েই টয়লেট সিটের ওপর বসে রইলেন কান্তিবাবু। প্যান্ট নামিয়েই বসেছিলেন। আসতে আসতে নিজে থেকেই শিশ্নের দিকে হাত চলে গেল। কত পরিচিত সঙ্গী... সেই কবে থেকে জেগে উঠছে, আর ঘুমোচ্ছে। কিন্তু আজ কেমন অদ্ভুত লাগছে, ঠিক যেমন আগে মাঝে মাঝে সিগারেট খাওয়ার সময় হ'ত... সিগারেট খেতে ইচ্ছে করছে, কিন্তু ফুসফুস ধোঁয়া সহ্য করতে পারছে না। একটা অদ্ভুত অস্বস্তি। নিজেকে যেন আখের মত সঁপে দিতে হয়েছে এই ছবির মেয়েটার কাছে। একটা সামান্য ছবি হঠাৎ আখ-মারাই কলের মত পিষে দিচ্ছে! "সত্যিকারের এমন মেয়েছেলে সামনে এলে কী হ'ত? দম আটকে মরেই যেতাম!" 
রণেন বলত "আজ যা এত সহজে করতে পেরেছিস... যে আমটা দেখে মনে হচ্ছে এক মিনিটে আঁটি চুষে ফেলে দেবো। একদিন দেখবি সেই আমের একটা চোকলা খেতে হাঁসফাঁস করছিস! অথচ তোর মাঝে মাঝেই ইচ্ছে হবে আম, কাঁঠাল, পেয়ারা, লিচু... এসব খেতে। অসময়, যখন মরশুম নয় তখনও হঠাৎ ইচ্ছে হবে। যদি পেয়েও যাস, খেলে দেখবি বদহজম হচ্ছে, অম্বল হচ্ছে। রাতে ঘুমোতে পারছিস না। অন্য কাউকে খেতে দেখলে হিংসে হবে। খিটখিটে হয়ে যাবি এই বিরক্তি দিনের পর দিন ঘাড়ে উঠে থাকবে। একে বলে মিডলাইফ ক্রাইসিস। তুই অনেক কিছু চাস... কিন্তু তোকে কেউ চায় না!" কথাগুলো মনে পড়তেই চোখের সামনে হঠাৎ মিনতির মুখটা ভেসে উঠল। কাগজটা ঠক করে মাটিতে পড়ে গেল হাত আলগা হয়ে। 

মিনতিদেবীর সঙ্গে কান্তিবাবুর বয়সের তফাৎ বছর পাঁচেকের। চাওয়া আর পাওয়ার মধ্যে তফাৎ টা দশ বছর আগে থেকেই টের পাচ্ছেন কান্তিবাবু। সত্যি বলতে, অনেক কিছুই আর ইচ্ছে করে না। হাত সরিয়ে নেন, মুখ ফিরিয়ে নেন... ঘুমিয়ে পড়েন। মিনতিকে কতটা ভালবাসেন, সেই নিয়ে কিছু প্রমাণ করতে ইচ্ছে হয় না। কিন্তু এটুকু বুঝতে পারেন... বাধ্য হয়ে কিছু করতে পারবেন না। আর, কাউকে মিথ্যে মিথ্যে খুশিও করতে পারবেন না। হঠাৎ এতদিন পর আজ এই বাথরুমে বসে ঘামতে ঘামতে মনে হ'ল - "আমি কি মিনতিকে পুরনো আসবাবের মত রেখে দিয়েছি তাহলে? যা থেকে তৃপ্তি নেই, তা আর গ্রহণ করছি না... ও বোঝে? নাকি... মিনতিই আমাকে আসতে আসতে সরিয়ে দিলো! কখনও তো জানতে চাইনি... আমাকেও তো ওর একই রকম..."
পুরুষের নারী শরীর পছন্দ হওয়া বা না হওয়ার ব্যাপার অনেক সময় একটা রান্না করা পদের সুস্বাদু থাকা আর না থাকার মত মনে হয়। ভাল লাগছে না, তাই ইচ্ছেও চলে যাচ্ছে সহবাসের। অথচ কোনও নারীও একই ভাবে বলতে পারে "বিস্বাদ ঠেকছে তোমার সব কিছু। আজ অন্য কিছু অর্ডার দিই?" আজকের দিনটাই যেন একদম অন্য রকম! বাথরুমের এই ঘরটা একটা ঘুপচি ইন্টেরগেশন চেম্বারের মত লাগছে। বাতাস একটু একটু করে কমিয়ে স্বীকারোক্তির দাবী করছে কেউ। "একটা কাগজের ছবি, তার থেকে এত কিছু? সত্যিই মাথা খারাপ হয়ে গেছে... রণেন ঠিকই বলত। ভীমরতি!"

ফ্লাশটা টেনে প্যান্ট-জামা ভাল করে সেট করে নিয়ে বেরিয়ে এলেন কান্তিবাবু। বেরিয়েই দেখতে পেলেন প্রশান্ত আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে ভিজে চুল আঁচড়াচ্ছে শিস দিতে দিতে। আয়নায় কান্তিবাবুর প্রতিবিম্ব দেখেই ঘুরে দাঁড়িয়ে বলল "আরে কান্তিদা... শরীর খারাপ নাকি?! এত ঘামছেন কেন?" 
- নাহ... তলপেটের কাছটা কেমন চিনচিন করছিল একটানা... তাই...
- ও... সকালে ক্লিয়ার হয়নি?
- সে যাকগে... বলছি, তোর কাছে এই ফোনের চার্জার হবে? জোগাড় করে দিতে পারবি? একদম চার্জ নেই রে। ডেড! 
মিনতিদেবীর অফ হয়ে যাওয়া ফোনটা তখনও কান্তিবাবুর পকেটেই ছিলো। ওটাও সঙ্গে নিয়ে এসেছিলেন ওয়াশরুমে ঢোকার সময়। বার করে প্রশান্তকে দেখাতেই প্রশান্ত হাত থেকে নিয়ে নিলো, তারপর "এই ব্যাপার?" বলে হাওয়া হয়ে গেল চোখের সামনে থেকে। ছেলেটা খুব কাজের, ঠিক কোথাও থেকে চার্জ দিয়ে নিয়ে আসবে। কান্তিবাবু শুধু গলা চড়িয়ে বললেন "বেশি দেরি করিসনি... ঘন্টা দুয়েকের মধ্যেই বেরুবো!"
"সত্যিই তো... মিনতির ফোনটাও বুক পকেটে নিয়ে ভুল করে চলে এসেছি। মিনতির ছোঁয়া... ওই ফোনটার জন্যই তাহ'লে..." ভাবতে ভাবতে বাথরুমের ঘরটার দিকে চোখ যেতেই দেখলেন কাগজটা তখনও মেঝেতেই পড়ে আছে। স্যাঁতস্যাঁতে মেঝেতে পড়ে ভিজে যাচ্ছে ক্রমশ জল টানতে টানতে। আর সেই লাস্যময়ীর ওপরেই জুতোর ছাপ ফেলে বেরিয়ে এসেছেন কান্তিবাবু। 

--- --- ---

ঠাকুর বলতেন " সংসার কামিনী-কাঞ্চনময়।  কামের থেকে গৃহীর মুক্তি নেই। তাহলে উপায়? মুখ ফিরিয়ে নিতে হয়।"
যেদিন প্রথমবার একজনের মুখে শুনেছিলেন, সেদিনই মনে হ'ল - চোখ কিছুই দেখতে ছাড়ে না। মিনতি আসার আগেও ছাড়েনি, মিনতি আসার পরেও না। চোখে পড়ে, চোখ খোঁজে... মনেও ধরে যায় মাঝে মাঝে। তাহ'লে কি এই মন পার্ভার্ট? এমন পার্ভার্শন কি কম-বেশি সকলের মধ্যেই থাকে? 
তখন থেকেই কথাটা কানে বাজত। 'মুখ ফিরিয়ে নাও'। 
"খিদে মানুষমাত্রই পায়... কারও একটু বেশি। তারা খিদে সামলানোর চেষ্টা করে। কন্ট্রোল করে। যারা বাইরে খাই-খাইটা দেখিয়ে ফেলে... তাদেরই লোকে বলে হ্যাংলা"
কান্তিবাবু চেষ্টা করে গেছেন... যাতে কেউ ওনাকে 'হ্যাংলা' না বলে। কেউ না বুঝলে জিজ্ঞেসও করবে না। আর না জিজ্ঞেস করলে ডিফেণ্ড বা জাস্টিফাই করার কিছু নেই। 
মুখ ফিরিয়ে নিতে নিতে একসময় হঠাৎ মনে হ'ত চারপাশে শুধু স্তন, নিতম্ব, যোনির ভিড়। যোনি আর লিঙ্গরা হেঁটে চলে বেড়াচ্ছে। স্রোত বয়ে যাচ্ছে চারপাশ দিয়ে। এর বাইরে কিছু নেই। প্লাগ আর প্লাগপয়েন্টের মত যোনি-লিঙ্গ সর্বস্ব সভ্যতা। ওর থেকেই সব। এ কেমন দর্শন, বা এ কেমন উন্মাদনা তা নিয়ে ভাবার ফুরসৎ পেতেন না কান্তিবাবু। বরং ভেতরটা আনচান করত। পায়ের তলা শিরশির করত, যেমন ভার্টিগো থাকলে হয়। একরকম ভার্টিগোই, নীচে পড়ে যাওয়ার আতঙ্ক... অতলে হারিয়ে যাওয়ার ভয়। আসক্তি কী না কে জানে... তবে আসতে আসতে নিজেকে অনেক রিল্যাক্সড মনে হ'ত। জোর করে মুখ ফিরিয়ে নিতে হ'ত না। ওই রণেনের কথা মতই - খিদেটা এমনভাবে ভেতরে রাখতেন, যে মাগুর মাছের খলবল শব্দ কেউ বাইরে থেকে শুনতেই পাবে না। 
তবে এসব নিয়ে এখনও নিজের কাছে খুব স্পষ্ট থাকেন, ঠিক-ভুল নিজের সঙ্গে আলোচনা করে নেন কান্তিবাবু। নিজেকে পাপী মনে হয় না... কোনওদিনও কাউকে অপমান করেননি, কারও অনিষ্টচিন্তা করেননি। মনে যদি কিছু থাকে, বা জাগেও... সে আর কী করা যাবে। চুপ থাকলেই হ'ল। আসলে চারপাশে অনেকেই বড় রকমের হিপোক্রিট। ভাবে কেউ কিছু বোঝে না। একটা ডিসিপ্লিনড, সিভিলাইজড সোসাইটি সামলে রাখতে যে কতরকম শৃঙ্খলার কোড অফ কণ্ডাক্ট বানাতে হয়! সেসব না থাকলে, আইন আর সোশ্যাল জাস্টিসের ভয় না থাকলে দেখা যেত কে কত বড় পুণ্যাত্মা! 

এইসব নিয়ে কান্তিবাবু এখন আর উদ্বিগ্ন হন না। সেসব অনেক বছর আগের কথা। এখন, এতদিন পর সূর্যশিশিরে আত্মসমর্পনের সময়ে হঠাৎ কেন এভাবে মিনতির মুখটা ভেসে উঠল, কিছুতেই বুঝতে পারলেন না। কাগজটাও ভিজে নষ্ট হ'ল। ওটা বাথরুমেই পড়ে আছে। তুলে ট্র্যাশক্যানে ফেলে দিলে ভাল হ'ত। এখন কেউ পেলে, সাঁওলি... মানে, ঐ রিসেপশনিস্ট মেয়েটা যদি বলে কান্তিবাবু নিয়ে গেছিল? "বলুক গে! কেউ কিছু বললে দেখা যাবে! শালা রিসেপশনে বসে সারাদিন ফোন করে মাইনে নিয়ে যায়! একটা সিনিয়র লোককে পাত্তা দেয় না। তার আবার কথা!" পাত্তা না পাওয়ার কথা মনে পড়তেই আবার সেই বিরক্তিভাবটা ফিরে এলো। বেশ জোরেই বলে ফেললেন "এক ঘণ্টার ওপর হয়ে গেল... প্রশান্তর কোনও পাত্তা নেই! বাড়ি নিয়ে গেছে ফোনটা চার্জ দিতে। কোনও সেন্স নেই!" 
"কী হ'ল কান্তি দা? কার সেন্স নেই?"
কান্তিবাবু খেয়াল করেননি, কখন ওঁর ম্যানেজার কেবিন থেকে বেরিয়ে ডেস্কের সামনে এসে দাঁড়িয়েছেন। কিছুক্ষণ ম্যানেজারের দিকে তাকিয়ে থেকে বললেন "ফোনটা... চার্জ নেই, চার্জারও পাচ্ছি না"।
- কী ফোন? কোন মডেল?
- ঐ নোকিয়ার... মডেল নাম্বারটা তো...
- বাপরে, সেই পিন চার্জার হ্যাণ্ডসেট নাকি? ওসব আর চলে? আপনার তো স্মার্টফোন ছিল!
- হ্যাঁ... মানে, ওই আমারটা আজ ঘরে রেখে আসতে হ'ল। এটা একটু ডিস্টার্ব করছে, ওয়াইফ একা থাকে, যদি দরকার টরকার। আমারটা রেখে এলাম, আর ওরটা নিয়ে এলাম আর কি!
- নিজের স্মার্ট ফোন, আর বৌদিকে সেই পুরনো সস্তা হ্যাণ্ডসেট! ভেরি ব্যাড কান্তিদা... ভেরি ব্যাড! সামনের মাসে মাইনে পেলেই ফার্স্ট নতুন ফোন কিনবেন!
কান্তিবাবু অনেকটা আত্মসমর্পণের ভঙ্গিতেই হাসতে হাসতে উঠে দাঁড়ালেন ম্যানেজারের সামনে। আর তো তিন-চার বছর! ম্যানেজারও হা হা করে হেসে মিটিংরুমের দিকে চলে গেলেন, মিটিং রুমের দরজা ঠেলে ঢোকার আগে ঘাড় ঘুরিয়ে জোরে বললেন "আমি কিন্তু বৌদিকে জিজ্ঞেস করব নেক্সট মান্থ! আই অ্যাম সিরিয়াস!" কান্তিবাবু বুঝতে পারলেন, অনেকগুলো মাথা ঘাড় তুলে একবার কান্তিবাবুকে দেখে নিলো। কেউ কেউ তাকিয়েই রইল, হয়ত প্রত্যুত্তরের আশায়। কিন্তু মিটিং রুমের দরজা বন্ধ হয়ে গেল। কান্তিবাবুও হাসতে হাসতে বসে পড়লেন। 
"কান্তিদা... আমিও কিন্তু বৌদিকে জিজ্ঞেস করব। মাইণ্ড ইট। আই অ্যাম সিরিয়াস!" অনির্বাণের গলা। সারাদিন যেন অপেক্ষা করে বসেছিল এমন একটা রিটার্নের। আবার কিছু চাপা হাসির শব্দ কানে এলো। অল্প বয়সে কান্তিবাবু কোনও সিনিয়র কলীগকে এটা বললে তিনি বলতেন "তোর বাবাকে জিজ্ঞেস করিস!"। আজ কান্তিবাবু শুধু বললেন "হ্যাঁ রে সালা!"

--- --- ---

- হ্যাঁরে, প্রশান্ত কি বাড়ি চলে গেল?
- আ আ... এটে ডাবে... ওর ব্যাগ পয়ে আটে। কাডে গেটে। 
গুটখা ঠাসা মুখেই যতটা সম্ভব বুঝিয়ে চলে গেল  শংকর। দাঁড়াল না। এদিকে ছ'টা বেজে গেছে। এখন অনেকেই সাতটা-আটটা অবধি কাজ করে, ওভার-টাইম ছাড়াই। তবে কান্তিবাবু অতক্ষণ টানেন না। নিজের মত গুছিয়ে নিয়ে বেরিয়ে পড়েন। "না পোষালে বলুক, ভি আর এস নিয়ে নেবো।", কিন্তু কেউ বলেও না। উলটে শুনছেন, সিনিয়রদের এক্সটেনশন দেওয়ার ব্যাপারে কথা চলছে। "বাচ্চা ছেলেগুলো চাকরি পায়না আর বুড়োদের এক্সটেনশন। এরা যে কী চায়!" কিন্তু প্রশান্ত যে একেবারে ডুবে গেল। এখন উপায়? আসতে আসতে নিজের ফাইলপত্র আজকের মত গুছিয়ে নিলেন কান্তিবাবু। তারপর বোতলে জল ভরার জন্য উঠে এদিক-ওদিক দেখতে লাগলেন, যদি প্রশান্ত এসে পড়ে। জল ভরতে ভরতেই একবার ভাবলেন, কাউকে জিজ্ঞেস করবেন যদি প্রশান্তর ফোন নম্বরটা থাকে, ওকে ফোন করা যায়।  তারপর আবার ভাবলেন, "মিনিট দশেক আরও দেখি, তারপর না হয়..." 

ম্যানেজারের কথাগুলোও কেমন লাগল শুনতে। "সত্যই তো! নিজের স্মার্টফোন, আর আমার পুরনো ফোনটা ওকে দিয়ে দিলাম। কই... মিনতি তো কোনওদিনও বলল  না... ওরও একটা নতুন ফোন চাই!!" মিনতি চায় না, সত্যিই মিনতি নিজের জন্য প্রায় কিছুই চায় না আর। আগে চাইত, আজ ভাবলে মনে সে যেন অনেক অনেক বছর আগের কথা। হঠাৎ পছন্দ হওয়া ভ্যানিটি ব্যাগ, ইমিটেশন দুল, ঘর সাজানোর চিনেমাটির পুতুল... রাস্তায় দিয়ে যেতে হঠাৎ করে যা চোখে পড়ে, মনে ধরে যায়। তারপর কী হ'ল? কবে থেকে বন্ধ করে দিলো চাওয়া? কিছুতেই মনে করতে পারলেন না কান্তিবাবু। অস্বস্তিটা আরও বেশি হচ্ছিল এটা মনে করে - মিনতি কিছুই চায়নি... চায় না। চাইবে না...

"একি কান্তিদা? সব গুছিয়ে আবার এসে বসলেন যে?" শ্রেয়সীর গলার আওয়াজ শুনে চমকে উঠলেন। বোকার মত শুধু বললেন "অ্যাঁ?" শ্রেয়শী বছর তিনেক হ'ল কাজ করছে এখানে। কর্মঠ। ভাল মেয়ে। শেখার ইচ্ছে আছে। কান্তিবাবুরও বেশ ভাল লাগে ওর ভদ্র ব্যবহার। টুকটাক কাজে ওঁকে সাহায্য করে দেয় শ্রেয়সী। বিশেষ করে যেগুলো প্রযুক্তি নির্ভর। শ্রেয়সী আবার জিজ্ঞেস করল "কী হ'ল কান্তিদা? কিছু হয়েছে?"
"তোর কাছে প্রশান্তর নম্বর আছে? ফোনটা নিয়ে যে কোথায় চলে গেল! ", প্রশ্নটা করেই মনে হ'ল খুব বোকামো হয়ে গেছে। কান্তিবাবু আবার বললেন "ন্‌-না... মানে কারও কাছে থাকলে ভাল হ'ত, একবার যদি..." শ্রেয়সী যে অপ্রস্তুত হয়েছিল, তা দেখেই বোঝা যাচ্ছিল। ওর কাছে প্রশান্তর নম্বর? তবে সেখান থেকে সামলে নিয়ে সঙ্গে সঙ্গে বলল "আরে ওই তো... শঙ্করদাকে বললেই দিয়ে দেবে... ও শংকরদা! প্রশান্তর নম্বর আছে? কান্তিদা টেনশন করছে বসে বসে! ফোন নিয়ে কোথায় পালালো?"  

ফোন করে প্রশান্তকে পাওয়া গেল। অফিসের কাজে অন্য একটা জায়গায় গেছিল, কাগজ-পত্র দিতে, জানালো - ফিরতে প্রায় সাতটা বাজবে। যখন ফিরলো, কান্তিবাবুর ফোনটা পকেটেই ছিল। প্রথমে বলল 'ভুলে গেছিলাম কাজের ঠেলায়', তারপর বলল 'খুঁজলাম, কিন্তু এই ফোনের চার্জার পেলাম না... যেতে দেরি হয়ে যাচ্ছিল।' যেন দু'টো অপশন দিলো, যে কোনও একটা বেছে নিতে হবে।

--- --- ---

এটিএম কার্ডের ব্যবহার আসতে আসতে রপ্ত করে নিয়েছেন। তবে নেটব্যাঙ্কিং, ফোন ব্যাঙ্কিং... এসব একেবারেই সামলাতে পারেন না কান্তিবাবু। এমনকি দোকানে-বাজারে কার্ড দিয়ে খরচ মেটাতেও ভরসা পান না। কী থেকে কী হয়ে যায়। চারদিক থেকে যাসব খবর আসে! চোরদেরও প্রযুক্তি আছে, নিত্যনতুন মাথা খাটিয়ে বার করা কায়দা আছে। সেই সব ভেবে এটিএম কার্ডও ঘরেই রেখে দেন। আলমারির ভেতর, সযত্নে। টাকা তোলার দরকার হ'লে বার করেন, আবার ঢুকিয়ে দেন। কিন্তু আজ অফিস থেকে বেরনোর পর থেকেই খালি মনে হচ্ছে "কার্ডটা সঙ্গে থাকলে ভাল হ'ত। একটা ফোন কিনতাম মিনতির জন্য!" অথচ পকেটে সেই পুরনো মানিব্যাগ, দিনের হিসেবে রাখা নোট... আর অচল মোবাইল ফোন। 
পাড়ার মোবাইল স্টোরের ছেলেটা খুবই পরিচিত। আজ জিনিস নিয়ে কাল দাম দিলেও কিছু বলবে না। কিন্তু তাও বাস থেকে নেমে দোনো-মনো করে মোবাইল ফোনের দোকানের দিকে না গিয়ে সুনীলের দোকানের দিকে হাঁটতে শুরু করলেন। "স্কুটারটা সকাল থেকে পড়ে আছে, গিয়ে দেখি... হয়ত ছুঁয়েও দেখেনি, বলে দেবে - কাল সকালে!"

স্কুটারের দোকানটা ব্যস্ত রাস্তাতে হলেও, মোড়ের মাথা থেকে সেদিকে যেতে হলে ক'টা ডান-বাঁ গলিতে বাঁক নিয়ে পৌঁছতে হয়। ওগুলো শর্টকাট। ব্যস্ত-রাস্তা ধরে এগোলে ঘুরপথ, সময় বেশি লাগে। রাত হয়ে গেছে, তাড়াতাড়ি ঘরেও পৌঁছতে হবে, মিনতি ফোন করেও পাবে না... ফোন সুইচড অফ। এইসব ভাবতে ভাবতেই শর্টকাটের রাস্তায় দ্রুত পা-চালিয়ে এগিয়ে গেলেন কান্তিবাবু। বাড়ি ফেরার পথেই দোকান। না সারালে, কাটিয়ে দেবেন। কিন্তু একবার মুখ না দেখালে পেয়ে বসবে। সুনীলকেও ফোন করে তাগাদা দেওয়া গেল না। একটা দিন পুরো নষ্ট। ঘামতে ঘামতে আবার সেই বিরক্তিটা রগের দু'পাশে চেপে ধরল। আছড়ে ফেলা রাগ। মধ্যবিত্ত আর কিচ্ছু না পারলে এরকমই কিছু না কিছু আছড়ে ফেলতে চায়। না পারলে যে কষ্টটা হয়, তা বোঝানো সম্ভব নয়। সেই মুহূর্তে, সেই মানুষটাই অনুভব করতে পারে। যারা এই আছড়ে ফেলার বাইরে বেরিয়ে আসতে পারে, তারা রাগকে অতিক্রম করার একটা স্তর পেরিয়ে এসেছে। ভেতর ভেতর অনেক কিছু আছড়ে ফেললেও, সেটা বাইরে আসে না। কান্তিবাবু অতটাও চাপতে পারেন না। বই, খাতা, কলম, এমনকি চশমা পর্যন্ত ভেঙেছেন ছুঁড়ে। তবে ওই, নিজের জিনিসের ওপর দিয়েই যায়। মিনতিদেবীর মুখে নিয়মিত 'ছেলে এসব দেখে শিখবে' শুনতে শুনতে অভ্যেসটা কমলেও, একেবারে যায়নি। 
রণেন বলত, "ছোট ছোট জিনিস দিয়েই ছোঁড়া শুরু। তারপর মানুষ কত কি ছুঁড়তে শিখে যায়! ছুঁড়ে ফেলে দেয়! যেদিন দেখবি ছোঁড়ার জন্য হাত তুলতে গেলেই হাত টনটন করছে... সেদিন বুঝবি - বুড়ো হয়ে গেছিস!"
ব্যস্‌, পকেট থেকে মোবাইল ফোনটা বার করেই আছাড় মেরে দিলেন মাটিতে। কান্তিবাবু খেয়ালই করেননি, উলটো দিক থেকে একটা মোটরবাইক আসছিল দ্রুত গতিতে। মোবাইল ফোনটা রাস্তার ওপর বাউন্স খেয়ে আর একটু দূরে গিয়ে সেই চলন্ত বাইকের স্পোকে লাগল, তারপর ছিটকে গেল খোলা নর্দমার দিকে। বাইকটাও সঙ্গে সঙ্গে বেসামাল হয়ে স্কীড করে গেল। দ্রুতগতিতে থাকলে যা হয়। রাস্তায় ঘষতে ঘষতে সোজা গিয়ে লাগল সামনের লাইটপোস্টে। সামনের জন বাইকের সঙ্গেই রাস্তায় ঘষে গেল, আর পেছনের জন তার ঘাড়ের ওপর ভল্ট খেয়ে সামনে আছড়ে পড়ল। কারও মাথায় হেলমেট নেই। বাইকের ইঞ্জিন থেমে গিয়ে শুধু সামনের চাকাটা ঘুরছিল। দুজনের কেউই আর নড়াচড়া করল না। বাইক অ্যাক্সিডেণ্টের আওয়াজ যেমন হয়।  একসঙ্গে কাছাকাছি সব কুকুরগুলো ডেকে উঠল। এত দ্রুত সব কিছু ঘটে যাওয়ার আকস্মিকতায় হকচকিয়ে গেলেন কান্তিবাবু। ফোনটার কী হ'ল, তা একেবারে মাথা থেকে বেরিয়ে গেলো। দু তিন জনকে ছুটে বাইকের দিকে যেতে দেখেই চটপট পাশের গলির অন্ধকারে সেঁধিয়ে গেলেন। তারপর একদম কোনও দিকে না তাকিয়ে সোজা এগিয়ে চললেন সেইদিকে, যেদিকে গলি মিশেছে, অন্য এক গলিতে। সেখান থেকে অন্য এক গলি... সেখান থেকে সামনের ব্যস্ত রাস্তায়। 

কোনও রকমে সুনীলের দোকান অবধি পৌঁছে বসে পড়লেন। শরীরের মধ্যে একটা স্পষ্ট অস্বস্তি অনুভব করলেন। সুগার ফল করলে, অথবা প্রেশার থেকে... এমন হয়। স্কুটারের কথা জিজ্ঞেস করতে পারলেন না। ব্যাগ থেকে আগে বোতলের জল বার করে মাথায়-মুখে-কানে সেই জলের ঝাপটা দিলেন। তারপর মুখ তুলে তাকিয়ে দেখলেন দোকানে আরও কিছু লোক রয়েছে। সুনীল মাথা নিচু করে বসে, দু-তিনজন ওর দিকে ঝুঁকে পড়ে কিছু বোঝাচ্ছে। একজন পরিচিত ছেলে এগিয়ে এসে জিজ্ঞেস করল, "এখন কী করতে এলেন কাকু? যান যান... কাল সকালে আসবেন!" কান্তিবাবুর মাথার ভেতর তখনও ঝিমঝিম করছে, কানের মধ্যে একটানা একটা চিঁইইই শব্দ শুনতে পাচ্ছেন। তাও স্বাভাবিক হওয়ার চেষ্টা করে থেমে থেমে বললেন "কেন? কী হয়েছে? এখানে এত লোক..."
- সে অনেক কেলো... আপনি এখন যান। এখানে বসে থেকে লাভ নেই।
- আমার স্কুটারটা...
- মানুষের প্রাণ নিয়ে টানাটানি... আর আপনি পড়ে আছেন স্কুটার নিয়ে। পারেনও। উফ! 
- অ্যাঁ কী হয়েছে? 
- উফ... এই তো একটু আগে দোকানের ছেলেটাকে এমন ক্যালালো। এমন স্প্যানার দিয়ে মাথায় চালিয়েছে যে... পুলিশ আসবে বলছে। হাসপাতালে যাওয়ার জন্য গাড়ি ডাকতে গেছে।  
- সেকি! কে মারলো ওভাবে? 
- কে আবার... সবাই জানে। ওই তো একটু আগে বাইকে স্পীড তুলে পালালো দু'জন। ওই গলি দিয়ে... দেখুন না, এখনও রক্ত পড়ে আছে দোকানের সামনে... এহ! 
কান্তিবাবু একবার সেই গলির দিকে দেখলেন, তারপর পড়ে থাকা জমাট রক্তের দিকে। তারপর সব ব্ল্যাকআউট হয়ে গেল। আর কিচ্ছু টের পেলেন না। 

--- --- ---

"কোথায় কষ্ট হচ্ছে? জল খাবে, এনে দেবো? "  
মিনতির কথাগুলো খুব আসতে শোনাচ্ছিল, যেন অনেক দূর থেকে এসে কানে পৌঁছচ্ছে। চুপচাপ আকাশের দিকে তাকিয়ে সিলিং ফ্যানের ব্লেড ঘুরতে দেখছিলেন কান্তিবাবু। ধীরে ধীরে ওপর থেকে দেওয়াল ধরে নামতে নামতে ছাত থেকে মিনতির মুখে এসে পৌঁছলেন। খুব পরিচিত এই চোখের দৃষ্টি, চাপা আশঙ্কা।   
কান্তিবাবুর স্বাস্থ্য নিয়ে উদ্বিগ্ন হ'লে মিনতিদেবী কান্তিবাবুকে আরও বেশি দোষারোপ করেন। মানসিক নিরাপত্তাহীনতা এগুলো করিয়ে নিয়ে।   কান্তিবাবু একটু ধাতস্থ হওয়ার পর থেকেই , ওঁর দায়িত্বজ্ঞানহীনতা নিয়ে নানারকম কথা শুরু করেছেন। একটু আগে অবধি উনি শুয়েছিলেন, এখন বালিশে ঠেস দিয়ে বসে আছেন।   
- "দেখলে তো? রোজ বলছি... টেস্টগুলো করিয়ে নাও... ভাগ্যিস দোকানের কাছে ছেলেগুলো ছিলো! রাস্তাঘাটে কিছু হ'লে..."
- "ক'টা বাজে... অনেক রাত?"
- "সে জেনে তোমার কী হবে?... তুমি চা-টা কিছু খাবে? 
কান্তিবাবু ঘাড় নেড়ে সায়ে দিলেন - 'হ্যাঁ'।  তারপর বললেন - "অফিসের ব্যাগটা ঠিকমত রেখেছ?" "না, ফেলে দিয়েছি!" বলে চলে যাচ্ছিলেন মিনতিদেবী, তারপর দরজা অবধি গিয়ে বললেন "কিন্তু ফোনটা? ওটা তো দেখলাম না? এমা! ফোনটা কোথায় গেল?!" 
- "চা-টা নিয়ে এসো। বলছি।"
- "মানে? বলছি আবার কী? ফোনটা কোথায়? পড়ে-টড়ে গেছিলে না কি?! ফোনটা হয়ত রাস্তাতেই..."
- "না... হারিয়ে গেছে। খারাপ হয়ে গেছিল এমনিতেই। যাক গে।"
- "সেকি?! কী করে হারালো? মিথ্যে কথা কেন বলছ? ওই তো অজ্ঞান হয়ে গেছিলে... তখনই... "
- "আহ! খ্যানখ্যান করে চেঁচিও না। অসহ্য!"
- "আমি তো অসহ্য হবই... আর সিমটা? সেটাও তো গেল তাহ'লে? বাবু তো কালও ফোন করে পাবে না!"
- "নতুন সিম আনিয়ে নেবো। তোমার বাবু কচি খোকা নয়। ওফ!"

মিনতিদেবী বিড়বিড় করতে করতে চলে গেলেন। কান্তিবাবু সেদিকে পাত্তা না দিয়ে চোখটা বন্ধ করে বসে রইলেন কিছুক্ষণ। সেই বাইকটা, মোবাইল ফোনের ছিটকে যাওয়া, বাইকের ঘষে যাওয়া, ছেলেদুটোর অবস্থা, কুকুরের চিৎকার, মাটিতে চাপ রক্ত... সব পর পর সিনেমার মত দেখতে পেলেন। গা'টা শিরশির করে উঠল। সুনীলের দোকানের ছেলেটারই বা কী হ'ল কে জানে। কী থেকে যে কী হয়ে গেল! 
ঠক করে একটা শব্দ পেয়ে চোখটা খুললেন। মিনতিদেবী চায়ের কাপটা টুলের ওপর রেখেছেন। "আবার মাথা ঝিমঝিম করছে নাকি? রাতে হালকা তরকারি দিয়ে দুটো রুটি খাও শুধু। সুগারের ওষুধটা আর খেতে হবে না আজ। আবার যদি রাতে সুগার ফল করে..." 
- তোমার রণেন কে মনে পড়ে?
- রণেন? সে আবার কে? 
- রণেন কে মনে নেই?!
- কে বল তো? তোমার কলেজের বন্ধু?... না না... ওই আমাদের বিয়েতে যে 'শ্রীকৃষ্ণকীর্তন' গিফট দিয়েছিল? 
- ধুস... আরে রণেন! জানো তো, রণেন বলতো - 'যেদিন কাউকে উপহার দিয়ে মনে আনন্দ পাবি না। জানবি তুই বুড়ো হয়ে গেছিস!' আর একবার... আর একবার একটা ফুটবল ম্যাচে বাজে রকম ফাউল করার পর বলেছিল "এইসব হলুদ কার্ড , লাল কার্ড থাকবেই। রেফারি দেখেনি বলে কেউ একজন এমনি এমনি পার পেয়ে যাবে, তা হ'তে দেওয়া যায় না।"
- অ্যাঁ? কার কথা বলছ বল তো? আমি তো মুখটাই মনে করতে পারছি না!
- কাল ভাবছি ছুটি নেবো... সিক লীভ। একটা নতুন ফোন কিনতে হবে... এবারে নতুনটা তোমার। পুরনোটা আমার। ঠিক আছে? 

কান্তিবাবু এমন অনেক কথাই চায়ের কাপে চুমুক দিতে দিতে বলতে লাগলেন। প্রশান্তর কথা, শ্রেয়সীর কথা, সামনের শনিবার সকালে গাড়ি-বুক করে কোথাও যাওয়ার কথা, ব্লাড-সুগারের দুটো টেস্টই করিয়ে নেওয়ার কথা, মিনতিদেবীর হাঁটুর ব্যথাটা অর্থোপেডিককে দেখানোর কথা, বিয়ের প্রথম বিবাববার্ষিকীতে কেনা চিনেমাটির ফুলদানীর কথা। অনেকদিন পর একটানা এত কথা বলছেন কান্তিবাবু। মিনতির খুব একটা ভাল ঠেকছে না। চিন্তিত মুখে ওনার দিকে তাকিয়ে শুনছেন... কিছু কিছু কথার উত্তর দিচ্ছেন। ওঁদের থেকে খানিকটা ওপরে ফুল স্পীডে ঘুরছে সিলিং ফ্যান। তার বাঁদিকে দেখা যাচ্ছে স্টীলের আলমারির মাথা, যেখানে মাকড়শার জাল আর ঝুলের আস্তারণ পড়ে গেছে। সেই আস্তরণের নিচে একটা সুটকেস, যার ভেতর ওঁদের ছেলে বাবু ব্যক্তিগত সিডি-ডিভিডি সন্তর্পণে লুকিয়ে রাখত। যাওয়ার আগে কিছু নিয়ে গেছে, কিছু ফেলে দিয়েছে। ও জানে না, যে ওর বাবা সবই জানে। আলমারির মাথার ওপর দেওয়ালের গায়ে চৌকো ঘুলঘুলি। তাকে এপার ওপার করে ভেতরে এসেছে কেবিল টিভির লাইন। তার ভেতরে থাকে গৃহপালিত টিকটিকিদের একটি বাড়ন্ত পরিবার। সেই ঘুলঘুলির বাইরের দেওয়াল নিম গাছের ডাল হাওয়ায় শিরশির করে ছুঁয়ে যাওয়া আলতো করে। নিম গাছে কাকের বাসা। গাছের ওপর কালচে নীল আকাশ, যেখানে এখনও দূষণ ভেদ করে ঝকঝক করে উঠছে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকা তারাগুলো। কান্তিবাবুর যদি আজ রাতে ঘুম ভেঙে যায়, উনি যদি ঘরের বাইরে এসে এই রাতের আকাশের দিকে তাকান, হয়ত মনে পড়ে যাবে... রণেন বলত - "যেদিন ছাতে কিংবা ঘাসের ওপর শুয়ে আকাশের দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে, তারাদের দেখতে দেখতে কারও কথা মনে পড়ে আর হাসি ফুটবে না... সেদিন বুঝবি - বুড়ো হয়ে গেছিস।" 


4 comments:

  1. অসাধারণ... দীর্ঘ হলেও ক্লান্তি লাগে না একফোঁটা

    ReplyDelete
  2. বেশ বেশ ভালো লাগলো
    - অলোকপর্ণা

    ReplyDelete
  3. bhalo laglo... Arghya Dutta

    ReplyDelete