পারাপার
( ১ )
লোকটাকে
রোজই একই জায়গায় বসে থাকতে দেখে সে।
শীতকালে
এমনিতেই গুটিকতক হোটেলস্টাফ বাদ দিয়ে মানুষজনের মুখ দেখতে পাওয়া এখানে সৌভাগ্যের
ব্যাপার, মাস দুয়েকে সে কথা বুঝতে অসুবিধা হয়নি তার।
আমেরিকার ওহাইয়ো প্রদেশের তলার দিকে একচিলতে একটা শহর সিনসিনাটি— লোকসংখ্যা
টেনেটুনে তিন লাখের কাছাকাছি। গাইডবুকে
হাসি মুখে মেয়র ফুলিয়ে-ফাঁপিয়ে যতই বলুক না কেন— মিউজিয়াম, চিড়িয়াখানা, খানকয়েক চার্চ আর ট্রামে চড়ে
ডাউনটাউনের চক্কর লাগাতে দুটো উইকএন্ডের বেশি লাগেনি।
তারপর শুধু গাড়ি চেপে হোটেল আর অফিস। দেখার মতো
জিনিস বলতে তুষারপাত— নিরবচ্ছিন্ন, নিঃশব্দ।
জীবনে
এই প্রথম স্বচক্ষে বরফ-পড়া দেখল সে। ক্লিশে
হলেও অনভ্যস্ত চোখে ব্যাপারটা দারুণ সিনেমাটিক লেগেছিল।
কিন্তু প্রথম পেরিয়ে দ্বিতীয়-তৃতীয় হয়ে চতুর্থ দিন থেকেই একটা একঘেয়েমি আসে।
তার ওপর সাত তাড়াতাড়ি বিকেল গিলে নেমে আসা সন্ধেগুলোতে যদি একমাত্র কাজ হয় ঘরবন্দি
হয়ে জানলার ধারে বসে একটানা বরফ পড়তে দেখা। কয়েকদিনেই
হাঁফিয়ে ওঠে সে, দিন গুনতে থাকে কবে শেষ হবে তিন মাসের এই প্রোজেক্ট! একাকীত্ব ব্যাপারটা
তাহলে ওভাররেটেড! ক্রমশ পুরনো সব আক্ষেপ নতুন করে চেপে বসে তার বুকের উপর, আরও দিন চারেক পর খেয়াল করে সে— প্রতি মুহূর্তে ঝরে পড়া তুষারের সঙ্গে
তার জীবন থেকেও যে ঝরে যাচ্ছে সুসময়! এমনটাই কি চেয়েছিল সে?
এত রোজগার, এত টাকা যে ব্যাঙ্কে পচছে, কী লাভ হচ্ছে তাতে? তার তো থাকার কথা ছিল লাইট-সাউন্ড-ক্যামেরা-অ্যাকশনের মাঝে, প্রিয় এক মানুষের সঙ্গে। কিন্তু
সেইসব ফেলে এ কোথায়, কী করছে সে!
তাই
সে একটা শেষ চেষ্টা করেছিল, অফিসের পর রিসেপশন লাগোয়া লবিতে স্টাফদের
অমায়িক ‘হাউ আর ইউ ডুয়িং?’ পেরিয়ে ফায়ারপ্লেসের পাশে বসে
কমপ্লিমেন্টারি বিয়ার বা রেড ওয়াইনে নিজের যাবতীয় আপশোশ চুবিয়ে ফেলতে।
কিন্তু সেইসবের পর দু’শো বারো নম্বরের নরম গদিতে যখন নিজেকে সঁপে
দেয়, তখনও সে ওয়েস্টপেপার বাস্কেটটা ঘেঁটে চলেছে ফিল্ম
ইনস্টিটিউটের ফর্মটার খোঁজে... সঙ্গে ভারী ভয়েসওভার— ‘ওসব ফিল্মমেকিং-টেকিং আমাদের
সেন বাড়ির ছেলেদের কম্মো নয়। ফাইনাল
সেমেস্টারের সাপ্লিমেন্টারি পেপারটা কীভাবে পাশ করা যায় তার ব্যবস্থা করো।’ কখনও
বা একটা পরিচিত মেয়েলি কন্ঠে— ‘স্পাইনলেস!’ ঘুমিয়ে পড়ার ঠিক আগে...
সকালবেলা
ব্রেকফাস্ট করার সময় যে আরও কয়েকজন বোর্ডারের সঙ্গে চোখাচুখি হয়নি তা নয়।
কিন্তু কারও সঙ্গেই এখানকার অলিখিত নিয়ম হাই-হ্যালোর বেশি এগোনো হয়নি। এই
লোকটি তার চোখ টানে ঠিক তিনটি কারণে। প্রথমত, বেশ ফোলা গাল দু’টি আর সামান্য উঁচু দাঁতের কারণে
বছর পঞ্চাশের লোকটার মুখে কাঠবিড়ালির একটা স্পষ্ট আদল আছে,
যা বিদেশিদের মধ্যে চট করে দেখা যায় না।
দ্বিতীয়ত, লোকটা প্রতিদিন বসে একই জায়গায়— ফায়ারপ্লেস ঘেঁষা তার প্রিয়
সোফাটার ঠিক মুখোমুখি। তবে তৃতীয়
কারণটাই সবচাইতে অদ্ভুত। প্রায় মাসখানেক আগে লোকটার সঙ্গে
যখন প্রথম চোখাচুখি হয়, লোকটা চোখ সরিয়ে না নিয়ে বেশ কিছুক্ষণ তার
দিকে অপলক চেয়েছিল, যেন চেনা কোনও মানুষের মুখ হঠাৎ নজরে
আসার পর পরিচিতি সঠিক কিনা মেপে নিচ্ছে।
তখন সে অবসাদের প্রাথমিক পর্যায়ে। হয়তো ব্যাপারটা চোখ এড়িয়ে যাবারই কথা ছিল। যায়নি।
লোকটার কাঠবেড়ালির মতো মুখখানার জন্য। তারপরেও সে
খেয়াল করে দেখেছে, উলটোদিকের চেয়ারে বসে থাকার সময় বিয়ারে
চুমুক দিতে দিতে তার দিকে ফিরে ফিরে দেখার একটা সুযোগও লোকটা হাতছাড়া করে না।
এদিনও
তার ব্যতিক্রম হচ্ছিল না, তবে যেহেতু বরফপড়ার মতোই এই ব্যাপারটাও তার
গা-সওয়া হয়ে গেছিল, সে বিশেষ পাত্তা না দিয়ে নিজের পছন্দের
জায়গায় জমিয়ে বসে একের পর এক স্যামুয়েল অ্যাডামসের ক্যান খালি করছিল।
তবে
লোকটা বোধহয় আজ খানিকটা ভিন্ন মেজাজে ছিল। তাকে তৃতীয়
ক্যান হাতে নিতে দেখে সামান্য নড়েচড়ে বসল। বোধহয় এক মাস ধরে জমে থাকা সংকোচ ঝেড়ে
ফেলতে চাইল এইভাবেই। তারপর অ্যাকসেন্টে মম করা ইংলিশে জিগ্যেস করল— ‘মিস্টার বিভোর সেন ফ্রম ইন্ডিয়া, ইজ ইট?’
লবিতে
তখন শুধুই ওরা দু’জন।
লোকটা
যতটা অবাক করে দিতে চেয়েছিল ততটা হল না সে। হয়তো
রিসেপশনিস্টের সঙ্গে তার কথোপকথন কখনও শুনে ফেলেছে আর আলাপ শুরু করার এর থেকে ভালো
উপায় লোকটার মাথায় আসেনি। কিন্তু কিছু একটা বলতে হয় তাই
হ্যাঁ-বাচক মাথা নেড়ে সে বলল— ‘হাউ ডু ইউ নো মি?’
লোকটা
সঙ্গে সঙ্গে উত্তর না দিয়ে লবির ওপাশের অ্যাবস্ট্রাক্ট পেন্টিংটার দিকে খানিকক্ষণ
চেয়ে রইল। বারদুয়েক বিয়ারে চুমুক দিল, তারপর বলল— ‘ডিফিকাল্ট কোয়েশ্চেন।’
আরও
কিছুক্ষণের নীরবতা। তারপর আবার লোকটা বলল— ‘আই অ্যাম ওটো... ওটো আইখহর্ন।’
কথার
সূত্র ধরে বিভোর জিগ্যেস করে— ‘তুমি এখানকার নও?’
লোকটা
এবারও উত্তর দিল না, শুধু হাসল।
আজব
তো!
আরও
কয়েকটা চুমুকের পর বলে উঠল— ‘নট ফ্রম হিয়ার।
সার্টেনলি নট।’
—‘জার্মানি?’
লোকটা
মৃদু হেসে সম্মতিসূচক মাথা দোলাল।
—‘আমাকে কীভাবে চিনলে বললে না তো!’
—‘ওই যে বললাম, কঠিন প্রশ্ন!’
—‘কেন জানতে পারি?’
উত্তরে
আবার খানিকক্ষণ সব চুপচাপ। অবশেষে
লোকটা নিজের লম্বাচওড়া শরীরটা একটু নাড়িয়েচাড়িয়ে ডান পা-টা বাঁ পায়ের ওপরে তুলে
গুছিয়ে বসে বলতে শুরু করে— ‘তোমার প্রশ্ন বারবার এভাবে এড়িয়ে
যাবার জন্য দুঃখিত। আসলে আমি
নিজেই বুঝতে পারছি না কীভাবে তোমার কাছে ব্যাখ্যা করব। আর করলেও তোমার কাছে সেটা
কতখানি গ্রহণযোগ্য হবে।’
যদিও
একটু আগেই বিভোর বলেছে সে কৌতূহল বোধ করছে, কিন্তু আদপে এতক্ষণ সে বিন্দুমাত্র
আগ্রহী হয়নি। তার আগ্রহের সূত্রপাত, বলা যেতে পারে এই মুহূর্ত
থেকে। আসলে এখন সে মনে মনে চাইছিল লোকটা তাকে
অবিশ্বাস্য কিছু একটা শোনাক। এমন কিছু, যা অন্তত আজকের রাতটার মতো তাকে নিজস্ব
চিন্তাভাবনা থেকে বিরত রাখবে।
—‘যাই
হোক’ লোকটা আরও কিছুটা সময় নিয়ে বলল—‘শুরু যখন করেই ফেলেছি তখন তোমার ধৈর্য্যের
একটা পরীক্ষা হয়েই যাক, কী বলো?’ এই বলে খানিকক্ষণ ধরে নিঃশব্দে হেসে নিয়ে
বলল—‘তার আগে একটা কথা বলো, প্যারালাল ইউনিভার্স সম্পর্কে তোমার কোনও ধারণা আছে?’
প্যারালাল
ইউনিভার্স? কোথাও কি পড়েছিল এ ব্যাপারে? সিলেবাসে না কোনও সাই-ফাই উপন্যাসে? নাকি
কোনও হলিউড সিনেমা হয়েছিল এই কনসেপ্টে? বিভোর মনে করতে না পেরে বলল— ‘খুবই
সামান্য... ওই আমাদের পৃথিবীর আদলে আরও একটা পৃথিবী...’
ওটো
মাথা নেড়ে বলল— ‘ঠিকই, কিন্তু শুধু একটা না, অসংখ্য আর শুধু তোমাদের পৃথিবী নয়;
ব্রহ্মাণ্ড।’
‘তোমাদের
পৃথিবী’ কথাটা লক্ষ করেও বিভোর বলল— ‘অসংখ্য!’
ওটো
মাথা নাড়ল— ‘সেই জন্যই তো বলে মাল্টিভার্স। অসংখ্য
পৃথিবী মানে বুঝতে পারছ তো? অসংখ্য তুমি অসংখ্য আমি।
মজার ব্যাপার হল পুরোটাই দাঁড়িয়ে সম্ভাব্যতার খেলার উপর।
মাল্টিভার্সে এমন একটা পৃথিবী থাকতেই পারে যেখানে হয়তো জলচর থেকে সরীসৃপের
ইভোলিউশনটাই হয়নি। আবার ধরো... আচ্ছা, আমি জানতে পারি তোমার
প্রফেশন কী?’
—‘সফটওয়্যার
ইঞ্জিনিয়ার।’
—‘ওকে!
ধরো আর্থ-ওয়ানে অর্থাৎ এখানে তুমি সফটওয়্যার ইঞ্জিনিয়ার, কিন্তু আর্থ-ইলেভেনের তুমি
ভারতের প্রধানমন্ত্রী আবার আর্থ-হান্ড্রেড অ্যান্ড ইলেভেনে তুমি একজন টেররিস্ট।
আমার কেমন যেন মনে হচ্ছে তোমাকে বোর করছি।’
—‘আদপেই
না। চালিয়ে যাও... প্লিজ!’
—‘ধন্যবাদ!
এবার আগে তোমার দ্বিতীয় প্রশ্নের উত্তর দি। আমি
এখানকার নই— জার্মানির, ঠিকই বলেছ, কিন্তু তোমার পৃথিবীর জার্মানির নয়। এই
মাল্টিভার্সে প্রোবাবিলিটির দিক দেখে যে পৃথিবীর সঙ্গে এই পৃথিবীর মিল সবচাইতে
বেশি, আমি সেই পৃথিবীর জার্মানি থেকে আসছি।’ ওটো এইটুকু বলে থেমে যেন বিভোরকে সময়
দিতে চাইল। বিভোর মনে মনে বলল, ‘চমৎকার!’ মুখে বলল— ‘আচ্ছা।’
ওটো
হয়তো অন্যরকম কিছু আশা করেছিল, কিন্তু বিভোর অবাক হল না দেখে সে মনে মনে যেন খুশিই
হল— ‘আমার নাম আগেই বলেছি, আমি আলটেনহাইম রিসার্চ ইনস্টিটিউটের টেকনিক্যাল
ডিপার্টমেন্টের হেড প্রোজেক্ট কোঅর্ডিনেটর। আমাদের
পৃথিবী মাল্টিভার্সের তত্ত্ব ও প্রয়োগে যে অনেকটা এগিয়েছে, তা তো দেখতেই পাচ্ছ।
সাতাশ জনের একটা টিম আমাকে রিপোর্ট করে যারা এই কোয়ান্টাম জাম্প নিয়ে প্রতিদিন
নানারকম গবেষণা করে চলেছে। সেই সুবাদেই
আমি আজ তোমার মুখোমুখি বসে আছি। এটাই আমার
প্রথম আউটিং, তাই ইতিহাস, ভূগোল, রাজনীতি, অর্থনীতি—এইরকম আরও নানাদিক থেকে আমাদের
পৃথিবীর সবচাইতে বেশি মিল আছে, একটা গন্তব্য বাছাই করেছি।
গবেষণা আর একটু এগোলে দূরবর্তী ডাইমেনশনগুলোতেও আমাদের অভিযান চলবে।’
এই
কথা ক’টা ওটো বলল একটানা এবং এতক্ষণ যে গতিতে কথা বলছিল তার প্রায় দ্বিগুণ বেগে।
বলা শেষ হবার পর বিভোরের চোখের দিকে জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল, যেন বুঝতে চায়
এই অবধি সে কীভাবে নিয়েছে এবং সেই বুঝে বাকিটুকু বলবে।
ওটোর
চোখের ভাষা পড়তে পেরে বিভোর হেসে বলল— ‘তোমার কথা অবিশ্বাস করার কোনও কারণ দেখছি
না। শুধু জানতে ইচ্ছে করছে— এই যে তুমি যা যা বললে সেটা নিশ্চয়ই জনে জনে বলে
বেড়াবার মতো কোনও ব্যাপার নয়। তাহলে হঠাৎ আমাকে বলছ কেন!’
ওটো
মাথা নেড়ে বলল— ‘খুবই সঙ্গত প্রশ্ন। এর উত্তর দিলে তোমার প্রথম প্রশ্নের উত্তরও
দেওয়া হয়ে যায় বই-কি। আমার সম্পর্কে বা আমাদের গবেষণার ব্যাপারে এখানে যাকে-তাকে
বলে বেড়ানো মোটেই কাজের কথা নয় আর আমি সেইরকম কিছু করছিও না। যদিও এখানে আসার আগে
এখানকার একটা রিসার্চ ইনস্টিটিউটের সঙ্গে যোগাযোগ করতে হয়েছিল। বুঝতেই পারছ আমি
এখানে বেড়াতে আসিনি, এসেছি গবেষণা করতে। তার জন্য লাগে রিসোর্সেস, টাকাপয়সা— অর্থাৎ
কিনা এখানকার ভ্যালিড কারেন্সি, আরও অনেক অনেককিছু। সেই ব্যাপারে এখানকার একটা টিম
আমাদের সাহায্য করছে। তার বদলে আমরাও অঙ্গীকারবদ্ধ কিছুটা নলেজ ট্রান্সফার, কিছুটা
টেকনোলজি ট্রান্সফারের। সে অনেক ব্যাপার— কিন্তু ওসবের সঙ্গে যার কোনও সম্পর্ক নেই
সেই তোমাকে এতকিছু বললাম একটাই কারণে। তোমাকে আমি আগেও দেখেছি। বলাই
বাহুল্য আমার পৃথিবীতে। আমাদের আলটেনহাইমে একটা ফিল্ম ফেস্টিভ্যাল হয় প্রতি বছর— বেশ
বিখ্যাত। দু’বছর আগে সেখানে একটা ডকুমেন্টারি
দেখেছিলাম— ভারতীয় বিজ্ঞানী নরেন্দ্রনাথ দত্তের উপর। অসম্ভব ভালো লেগেছিল আমার!
নরেন্দ্রনাথ ফিজিক্সে আমাদের গ্রহের সর্বোচ্চ সম্মান ‘স্টেফানি’— তোমাদের নোবেলের
সমতুল্য বলতে পারো— পেয়েছিলেন ১৯০৯ সালে। তারপর থেকে তাকে নিয়ে দেশে-বিদেশে কম
তথ্যচিত্র হয়নি, তার বেশ কয়েকটা দেখার সৌভাগ্য আমার হয়েছিল। কিন্তু এমন ইউনিক
ট্রিটমেন্ট কোথাও দেখিনি... তোমার মুখের মিটিমিটি হাসির কারণ বুঝতে পারছি। এই
ডাইমেনশনে এসে প্রথম তিন মাস এই গ্রহের ইতিহাস সম্পর্কে মোটামুটি ধারণা করা যায়
এমন কয়েকটা বই আমি পড়ে ফেলি। নরেন্দ্রনাথ দত্ত তোমাদের এখানেও বিখ্যাত ব্যক্তি,
তাই তো? তবে জেনে রাখো এ নিছকই নামের মিল নয়। তোমাদের এখানে যিনি সন্ন্যাসী,
আমাদের ওখানে তিনিই বিজ্ঞানী।’
বিভোর
হাসতে হাসতে বলল— ‘বুঝলাম বুঝলাম। তা সেই
ডকুমেন্টারির সঙ্গে আমার... মানে তোমাদের বিভোর সেনের কী সম্পর্ক?’
—‘খুবই
সোজা! আমাদের বিভোর সেন তথ্যচিত্রটির পরিচালক।’
কথাটায়
কী প্রতিক্রিয়া হওয়া উচিত বিভোর তা চট করে বুঝে উঠতে পারল না। একটা অসম্ভব খুশির
দমক তাকে ঝাপটা দিয়ে গেল শুধু।
ডিরেক্টর!
সে ফিল্ম-ডিরেক্টর! হোক না ডকুমেন্টারি তবু তো... কিন্তু সে-ই কি এই ডিরেক্টর?
না-পাওয়াগুলো কি এইভাবেই পাওয়া যায়? ‘স্বপ্নের জগৎ’ কথাটা তাহলে কি মিথ নয়? এই কি
তার বৈজ্ঞানিক ভিত্তি?
এতসব
চিন্তার মাঝেও তার কান তখন ওটোর প্রতি সজাগ— ‘সেবার ফেস্টিভ্যালের শেষে অ্যাওয়ার্ড
সেরেমনির সময়ে তোমাকে দেখেছিলাম। আর এখানে তোমাকে দেখে লোভ সামলাতে পারলাম না, বড়
ইচ্ছে হল অমন একজন তরুণ প্রতিভাধর পরিচালক এখানে কী করছে জানবার। সফটওয়্যার
ইঞ্জিনিয়ার! তাও মন্দ নয়। আমারটা শুনবে? তোমাদের পৃথিবীতে ওটো আইখহর্ন কী জানো?’
—‘কী?’
—‘কফিমেশিন
মেকানিক।’— বলে ওটো একা-একাই খানিকক্ষণ হেসে নিল— ‘সত্যি বলতে কি এখানে পৌঁছে সবার
আগে আমি জার্মানিতেই আমাদের বেস করেছিলাম। উদ্দেশ্য একটাই— এই পৃথিবীর আমির সাথে
মোলাকাত। কিন্তু কোথায় কী! এখানকার আলটেনহাইমে আমার পাড়া, আমার বাড়ির কোনও
অস্তিত্বই নেই! তখনই বুঝলাম এখানকার ইতিহাস ভালোভাবে জানা না থাকলে এগোনো যাবে না।
সেই অনুযায়ী পড়াশুনা করে জানতে পারলাম, আমার পূর্বপুরুষ না সেই ১৮৬০-এর দশকে এই
শহরে এসে ঘাঁটি গেড়েছে। আমার টিমকে জানালাম, ওরা আলটেনহাইম থেকে এই সিনসিনাটিতে
পোর্টাল খুলে দিল। তারপরও আমার কাউন্টারপার্টকে খুঁজে পেতে কম কাঠখড় পোড়াতে হয়নি।
তার বাসা কেন্টাকির কভিংটনে— এক ঘুপচি অ্যাপার্টমেন্টে। এককালে কফিমেশিন সারিয়ে
বেড়াত, এখন একেবারে ঘরে বসা। ফুসফুসে ক্যান্সার বাসা বেঁধেছে, বউ মারা গেছে,
দেখাশোনা করার কেউ নেই, টাকাপয়সার অবস্থাও খুব খারাপ, নিজের হেলথ ইনসিওরেন্সের
প্রিমিয়াম পর্যন্ত দিতে পারে না বেচারা! দেখে মনটা এত খারাপ লাগল, কয়েকশো ডলার
রেখে চলে এলাম। এর বেশি কী-ই বা করতে পারি!’
ওটো
থামতেই বিভোর জিগ্যেস করল— ‘তোমাদের এই কোয়ান্টাম জাম্পের পদ্ধতি কি খুব জটিল?
মানে তোমার কথা শুনে তো তা মনে হচ্ছে না? যে কেউ এটা করতে পারবে?’
ওটো
সামান্য হেসে জিগ্যেস করল— ‘যে কেউ নয়, তুমি করতে পারবে কিনা জানতে চাইছ, তাই তো?’
বিভোর
শুধু হাসল, কিছু বলল না।
—‘নিজের
ফিল্মমেকার ভারশনের সঙ্গে দেখা করতে ইচ্ছে করছে বুঝি?’
বিভোর
একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল— ‘হয়তো লক্ষ করোনি, তোমাদের বিভোর সেনের কথা প্রথম শুনে
কেমন হকচকিয়ে গেছিলাম। আসলে উঁচু ক্লাসে পড়ার সময় থেকেই আমার ইচ্ছে ছিল ফিল্মমেকার
হবার। কিন্তু বাড়ির চাপে... সে অনেক কথা, পরে ইচ্ছে হলে বলব। তোমাদের পৃথিবীতে কী
জানি না, আমাদের পৃথিবীর ভারতবর্ষ দেশটায় এমন অনেক অদ্ভুত ব্যাপার-স্যাপার হয়।’
ওটো
শুনতে শুনতে বলল— ‘অসাধারণ! তাহলে তো হের সেনকে একটু ওপারের সফর করিয়ে আনতেই
হচ্ছে!’
কথাটা
বলে ওটো কী যেন একটা ভাবতে বসল। তারপর বলল— ‘এই উইক-এন্ডটা বাদ দাও। ওদিকেও বেশ
কিছু গোজগাজ করতে হবে। পরের শুক্রবার আমি তোমাকে আমার ঘরে নিয়ে যাব আর সেখান থেকে
আমার পৃথিবীতে। আর তুমি ঠিকই ধরেছ, আমাদের পদ্ধতিটা মোটেই জটিল নয়। সব কিছু
সহজ-সরল রাখাই ছিল আমাদের গবেষণার অন্যতম প্রধান লক্ষ।’
( ২ )
চেনা-অচেনায়
মেশা একটা শহর, এ কি কলকাতা ? কলকাতাই তো, তার চিরপরিচিত... কিন্তু তাও কত আলাদা—
এমনকি এখানকার রোদ যেন মনে হয় বেশি উজ্জ্বল, আকাশ একটু বেশি নীল।
বাইরে
থেকে চোখ ফিরিয়ে নিজের হাতে বাঁধা বড়সড় ঘড়িটার ঘুমন্ত স্ক্রিনে নিজের মেক-আপটা
শেষবারের মতো দেখে নেয় বিভোর। ওটোর হাতেও এইরকম একটা ঘড়ি দেখেছে সে। পারাপারের
যন্ত্র বলতে এটুকুই! প্রথমটায় বিশ্বাস হয়নি তার, কিন্তু আর তো অবিশ্বাসের প্রশ্নই
নেই। ওটো যদিও বলছিল এই ‘স্মার্ট ওয়াচ’-এর পিছনে আছে কয়েক শতকের গবেষণা, জটিল সব
থিওরি আর তাদের অ্যাপ্লিকেশন, সবশেষে অনেক অনেক ক্যালকুলেশন। আর তাছাড়া ওপাশে তার
টিম যা সব টেকনোলজি ব্যবহার করে, দেখলে নাকি বিভোরের পৃথিবীর অনেক বিজ্ঞানীর চোখ
চকচক করবে।
সবই
ভালো, তবে বিভোরের কেবলই মনে হচ্ছে হুটোপাটিতে ছদ্মবেশটাই যা খেলো হয়ে গেল। চাপদাড়ি
লাগিয়ে চেহারা ঢাকার কায়দাটা, ওটোর মতে, পুরনো হলেও এখনও বেশ কার্যকর, এমনকি তার
পৃথিবীতেও। সে নিজেও নাকি এইভাবেই নিজের মেকানিক
ভারশনের সঙ্গে দেখা করতে গিয়েছিল। যদিও চাপদাড়ির পাশাপাশি বিভোরকে সামান্য মেকআপ
করানো হয়েছে, কিন্তু তার নিজেকে চিনতে বিশেষ অসুবিধা হচ্ছে না। আর তাহলে তো যার
সঙ্গে দেখা করতে যাচ্ছে, তারও...
—‘আর
মিনিট পাঁচেক... তুমি রেডি তো?’ ফ্রেডরিখের প্রশ্নের জবাবে নীরবে থাম্বস আপ দেখায়
বিভোর।
ওটো
নিজে আসতে পারেনি, ওই ডাইমেনশনে তার এখনও বেশ কিছু কাজ বাকি পড়ে আছে, কিন্তু সব
ব্যবস্থা করে দিয়েছে। এই ফ্রেডরিখ, যে একটি দৈত্যবিশেষ হবার দরুণ কুঁকড়ে বসে
ড্রাইভ করছে, কলকাতার জার্মান দূতাবাসে কাজ করে। ওটোর এক বিজ্ঞানী বন্ধুর ছেলে।
স্ক্রিপ্টটা ফ্রেডরিখেরই। সে সেজেছে একজন জার্মান ফিল্ম-জার্নালিস্ট, যে কিনা
এদেশের উঠতি ডকুমেন্টারিমেকারদের নিয়ে একটা ধারাবাহিক ফিচার লিখছে জার্মানির এক
ম্যাগাজিনে। বিভোরও একজন জার্নালিস্ট, তবে এখানে তার ভূমিকা মূলত দোভাষীর। সকাল
সাড়ে দশটায় অ্যাপয়েন্টমেন্ট, সেটাও ফ্রেড ইমেল করে সেরে রেখেছে।
—‘এই
বাড়িটার সেকেন্ড ফ্লোরে।’ বাড়িটার পাশের একটা সরুগলিতে পার্ক
করতে করতে বলল ফ্রেড।
গাড়ি
থেকে বেরিয়ে এলাকাটায় চোখ বুলিয়ে নেয় বিভোর। কলকাতায় এক মধ্যবিত্ত পাড়া, বুঝতে
অসুবিধা হয় না। তবে যে অঞ্চলে তার বাড়ি, তার সঙ্গে এই পাড়ার কোনওরকম মিল নেই।
—‘এটাই...
ফ্ল্যাট নাম্বার সি-ওয়ান।’ ফ্রেড কলিংবেলে চাপ দেয়।
যে
দরজা খোলে তাকে দেখে বিভোরের এত যে হিসেবনিকেশ, প্রস্তুতি— সব নিমেষে ওলট-পালট হয়ে
যায়। ঈশানী! ঈশানী এখানে কেন? তবে কি এই বিভোর সেন...
ঠিক,
ঠিক... তা-ই তো হবার কথা! বিভোর ভাবতে থাকে... ঈশানী তাকে বলেছিল ‘স্পাইনলেস’। তারপর
এডিটিং নিয়ে পড়তে একাই পুনে চলে গিয়েছিল। তাদের সম্পর্কেরও সেখানেই ইতি। এই
পৃথিবীর বিভোর সেন যে স্পাইনলেস নয়, তা তো বোঝাই যাচ্ছে। অতএব ঈশানীকে পেতে তার
কোনও বাধা থাকার কথা নয়।
এত
শত চিন্তার জালে জড়িয়েও বিভোরের চোখ এড়ায় না, কোনও এক অজ্ঞাত কারণে ঈশানীর চোখ লাল
হয়ে রয়েছে, চোখের কোলে কান্নার ছাপও স্পষ্ট। পরিচয় দেবার আগেই ধরা গলায় ‘স্ট্রেট
অ্যাহেড, দ্যাট রুম’ বলে পাশের একটা ঘরে মিলিয়ে গেল।
গোটা
ব্যাপারটাই সিলেবাসের বাইরে। ফ্রেডের পিছন-পিছন ঈশানীর দেখিয়ে দেওয়া ঘরে মিলিয়ে
যেতে বিভোর আপ্রাণ চেষ্টা করছিল নিজেকে গুছিয়ে নিতে, কারণ এইবার সে এক অনন্য
অভিজ্ঞতার শরিক হতে চলেছে।
ফ্রেড
ঘরের দরজায় বারদুয়েক আলতো টোকা দিল। তার বড়সড় শরীরটা বিভোরের দৃষ্টি আড়াল করে
রেখেছে, সে শুধু একটা অতি পরিচিত কণ্ঠস্বর শুনল— ‘কাম ইন, প্লিজ কাম ইন!’ ফ্রেড
ঘরে ঢুকতেই আড়াল সরল আর বিভোর দেখতে পেল পরিচালক বিভোর সেনকে।
সে
যা হতে চেয়েছিল, যাকে পেতে চেয়েছিল, এই লোকটি তা সবই পেয়েছে। বিভোরের বুকের ভিতরটা
একটু জ্বালা করে। এ কি হিংসা? তবু সে মুগ্ধদৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে প্রতিশ্রুতিমান
পরিচালকের দিকে।
কিন্তু
বিভোর সেনকে কেমন যেন দিশেহারা লাগে। একটু যেন অগোছালো— নইলে অ্যাপয়েন্টমেন্ট থাকা
সত্ত্বেও কেন তাদের বসতে দিতে দুটো চেয়ার থেকে বইপত্র সরাতে হবে! আর বেশ কিছুটা
বিষণ্ন। নিজেরই মুখের ভাব চিনতে বিভোরের ভুল হয় না।
তাদের
গুছিয়ে বসতে মিনিট কয়েক কেটে যায়। এরপর বিভোর ফ্রেডের চিত্রনাট্য অনুযায়ী কিছু কথা
মেকি কণ্ঠস্বরে আউড়ে যায়— কাজটা সে বেশ ভালোই সামলে দেয়। বিভোর সেনও চেষ্টা করে
সেগুলো মন দিয়ে শুনতে, কিন্তু তার ছটফটানি ওদের দু’জনের চোখ এড়ায় না। যদিও
প্রশ্নোত্তর পর্ব চলতে থাকে।
—‘সত্যি
বলতে কী’ পরিচালক একসময় একটু স্থির হয়ে বসে বলতে চেষ্টা করেন— ‘এত ভালো ভালো
ডকুমেন্টারিমেকার থাকতে আপনারা যে আমার কথা ভেবেছেন, এটা শুনে আমার যত না ভালো
লেগেছে তার থেকে অবাক হয়েছি বেশি।’
—‘আপনারও
তো একটা ডকুমেন্টারি আমাদের দেশেই পুরস্কৃত হয়েছে।’ ফ্রেড ইচ্ছা করেই জার্মানে বলে
যাতে বিভোর অনুবাদ করতে পারে।
—‘ওই
আর কী। আসলে ডকুমেন্টারি আমার প্যাশন নয়। যদিও আমি ডকুমেন্টারি আর শর্টফিল্ম
বানিয়েই শুরু করেছিলাম, নরেন্দ্রনাথটা আমার দ্বিতীয় তথ্যচিত্র। নিজে সায়েন্সের
ছাত্র ছিলাম, আমার ইউনিভার্সিটি থেকেই নরেন্দ্রনাথ নিজের কেরিয়ার শুরু করেছিলেন।
তা ওরা কাজটার ভার আমার মতো আনকোরা লোকের হাতে কেন দিয়েছিল সেটাও এক রহস্য। যাই
হোক, ছবিটা বানালাম ডকু-ফিচার ঢঙে। সত্যি বলতে এর আগে ওনাকে নিয়ে যে কাজগুলো হয়েছে,
তা তথ্যচিত্রই বলুন আর কাহিনিচিত্রই বলুন, সব খাজা। মানুষটাকে সন্ন্যাসী-টাইপ না
বানালে যেন চলবে না। ‘বিজ্ঞানসাধক’! আরে কী মুশকিল, ওইরকম ট্যালেন্টেড একটা
মানুষের লাভলাইফ থাকতে পারবে না! ওনার ছাত্রী পরে ফেলো-রিসার্চার মার্গারেট
নোবেলের সঙ্গে সম্পর্কের কথা বোধহয় আমিই প্রথম খোলাখুলি তুলে ধরি। আপনি বলছেন
বিদেশের পুরস্কারের কথা আর আমি ভাবছি স্বদেশের গালাগালির কথা। তবে কাজটা করে আনন্দ
পেয়েছি, অস্বীকার করব না।’
—‘আপনি
বলছেন ডকুমেন্টারি আপনার প্যাশন নয়, তবে কি ফিচার ফিল্মের...’
—‘অবশ্যই।
ফিচার ফিল্ম করব বলেই তো এসেছিলাম। দু’বছর আগে অনেক খেটে একটা বানালামও, জানেন।
বিদেশের কয়েকটা কার্নিভ্যালে দেখালাম, অনেকে প্রশংসা করল, দু’-একটা অ্যাওয়ার্ডও
জুটল, কিন্তু... কিন্তু এদেশে ডিস্ট্রিবিউটরই জোটাতে পারলাম না। এখনও রিলিজ করল না
ছবিটা!’
বিভোর
সেন এবার আনমনে নিজের মাথার চুলগুলো এলোমেলো করতে থাকেন, কিছুক্ষণ পর আবার নিজেই
বলে ওঠেন— ‘শেষ দু’-আড়াই বছরে একটা কাজও করিনি। ফিনান্সারই নেই। এক বেটাচ্ছেলেকে
‘চরাচর’ মানে—’
—‘জানি,
আপনার প্রথম ছবি।’
—‘হ্যাঁ,
ছবিটা দেখালাম। সে মাসখানেক খুব ভালো-ভালো কথা বলে ঘোরাল।
তারপর একটা রদ্দি পাঞ্জাবি সিনেমা দেখিয়ে বলে কিনা এটার রিমেক বানাও। পাবলিক নাকি
এইসবই খায়। জঘন্য!’
বিভোর
ফ্রেডের আশায় না থেকে নিজেই চোখ সরু করে জিজ্ঞেস করল— ‘তা আপনি করছেন না কেন?
একেবারে কিছু না করার থেকে—’
—‘দূর,
দূর!’ বিভোর সেন তাকে শেষ করতে না দিয়েই বলে উঠলেন— ‘রিমেক করব বলে বাবার সঙ্গে
ঝগড়া করে ফিল্ম নিয়ে পড়তে গেছিলাম নাকি! তবে জানি না—’ দীর্ঘশ্বাস ছাড়ার জন্য একটু
থেমে আবার বলতে থাকেন— ‘জানি না আর কতদিন নিজেকে এই রিমেকের কালচার থেকে বিরত
রাখতে পারব। খোলাখুলি বলছি, আমার আর্থিক অবস্থা খুব শোচনীয়। দু’বছর ধরে কোনও কাজ
নেই... বুঝতেই তো পারছেন। একটা রিমেক বানালেই কিন্তু কিছুটা সামলে নেওয়া যাবে... দু’-চারটে
বানালে তো আর কথাই নেই, হয়তো আমার ড্রিম ভেঞ্চার— এই দু’বছরের অপর্যাপ্ত অবসরে যার
স্ক্রিপ্ট লিখেছি, সেটা হয়তো নিজেই ফিনান্স করতে পারব। কিন্তু ওই—’ বিভোর সেন এবার
বুকের বাঁদিক দেখান— ‘এইখান থেকে সায় পাচ্ছি না।’
বিভোর
বলে— ‘আমি বুঝতে পারছি...’
বিভোর
সেন যেন আজ অনেকদিন বাদে মনের কথা বলার মতো কাউকে পেয়েছেন— ‘এদিকে আমার পারিবারিক
সম্পর্ক ভেঙে পড়ছে। বাবা-মায়ের সঙ্গে যোগাযোগ নেই সেই ফ্লিল্ম স্কুলে ভর্তির সময়
থেকে। এখন যিনি আপনাদের দরজা খুলে দিলেন, আমার স্ত্রী, ‘চরাচর’-এর প্রোডিউসার ও-ই
বলা যায়। নিজের গয়না বিক্রি করে ও আমাকে ছবিটা বানাতে দেয়, তারপর নিজেদের
ইনভেস্টমেন্ট ভেঙে আমরা ছবিটাকে বিদেশে পাঠাই। ওর সঙ্গে আমার আলাপ ইউনিভার্সিটিতে,
তারপর একই ফিল্ম স্কুল... অনেক স্বপ্ন দেখেছিলাম দু’জনে... ভালো ভালো ছবি বানাব...
নিজেদের ইচ্ছের সঙ্গে কখনও আপস করব না। সেই ওর সঙ্গেই এখন রোজ আমার ঝগড়া, কেন আমি
সূরজলালের প্রস্তাবে হ্যাঁ বলছি না, কেন আমি রিমেক বানাচ্ছি না। ভাবতেই পারি না যে
বিয়ের পর ও এত... আসলে...’
—‘আসলে
কী? বিভোরবাবু?’
—‘আসলে
আমাদের পরিবারে এক নতুন সদস্য আসতে চলেছে। খবরটা আনন্দের হলেও সময়টা বড়ই ভুল।’
বেশ
কিছুক্ষণের নীরবতা। তারপর বিভোর সেন শ্লেষমাখানো গলায় বলেন— ‘তা এই হল আমার হাল।
এসব যেন আবার লিখবেন না!’
( ৩ )
—‘তোমারও
তাহলে আমার দশাই হল।’ রেডওয়াইনে একটা ছোট্ট চুমুক দিয়ে ওটো বলে— ‘এই হয়। নিজের
সঙ্গে দেখা করাটা মোটেই তেমন সুখের ব্যাপার নয়।’
বিভোর
দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল— ‘ঠিক তা নয়, জানো! ওর জীবনের সঙ্গে আমার জীবনের বেশ মিল... কয়েকটা
ডিসাইসিভ জায়গা ছাড়া। যখন তোমার কাছে ওর কথা প্রথম শুনেছিলাম, ভেবেছিলাম, আহা, ও
বোধহয় খুবই সুখী। কিন্তু এখন দেখছি ও-ও ওর নিজের মতো
করে অসুখী। যদিও ওর অসুখী হবার পিছনে দায়ী ওর চারিত্রিক দৃঢ়তা, একটা জোরালো আদর্শ,
যেটা আমার মধ্যে নেই। সেদিক থেকে দেখতে গেলে আমরা ভীষণ আলাদা। ওর এই ব্যাপারটা
আমার খুব ভালো লেগেছে।’
ওটো
মাথা নেড়ে সায় দিল।
কথা
হচ্ছিল ওটোর ঘরে বসে। ঘন্টাখানেক হল বিভোর নিজের পৃথিবীতে ফিরে এসেছে। প্যারালাল
ইউনিভার্স, কোয়ান্টাম জাম্প— কথাগুলো যতই ভারিক্কি শোনাক, ওর শরীরে ক্লান্তি বলে
কিছু নেই। তাই এসেই ওটোকে নিজের অভিজ্ঞতা শোনাতে বসে গেছে।
একটু
থেমে বিভোর আবার বলল— ‘আমি বিয়োন্ড কারেকশন, কিন্তু ওর অবস্থাটা বদলানো যায়। আমার
মাথায় একটা আইডিয়া এসেছে। কিন্তু আবারও তোমার সাহায্য লাগবে।’
—‘বলো,
শুনি।’
—‘ব্যাপারটা
দাঁড়াচ্ছে এই— তোমার পৃথিবীতে আমার আর্থিক অবস্থা শোচনীয় অ্যান্ড ভাইস ভারসা। আমরা
দু’জনেই চাই সমান্তরাল পৃথিবীতে নিজেদের সাহায্য করতে, কিন্তু তাতে প্রধান বাধা
আমার পৃথিবীতে তোমার কারেন্সির কোনও দাম নেই অ্যান্ড ভাইস ভারসা। তাহলে কেন না আমি
এই পৃথিবীর তোমাকে সাহায্য করি আর...’
—‘আর
ভাইস ভারসা!’ ওটো উত্তেজিত হয়ে বলে— ‘আআআহ! এটা আমার মাথায় কেন আসেনি! আমি পরশু
ফিরছি, গিয়েই একজনকে ফিনান্সার সাজিয়ে বিভোর সেনের কাছে পাঠাব।’
—‘আর
আমি এখানকার ওটো আইখহর্নের সমস্ত চিকিৎসার ভার নিলাম। আরও মাসখানেক আছি এখানে,
পরের বছর হয়তো আবার আসব। কোনও অসুবিধা হবার কথা নয়। যোগাযোগ রেখো। দরকারে কলকাতায়
চলে এসো। তোমাদের কাছে তো পোর্টাল ওপেন করে যে কোনও পৃথিবীর যে কোনও জায়গায় যাওয়া
ওয়াইনে চুমুক দেওয়ার মতোই সহজ।’
—‘অবশ্যই।
সে তোমাকে ভাবতে হবে না। উফ! মনে হচ্ছে বুকের উপর থেকে একটা পাথর নেমে গেল।’
এইরকম
কিছু বিভোরও বলতে পারত, কিন্তু কিছু বলল না। ওয়াইনে চুমুক দিতে দিতে হাসিমুখে
জানলার বাইরে বরফ-পড়া দেখতে লাগল।
আজ তুষারপাত দেখতে সেই প্রথম দিনের মতোই ভালো
লাগছে।
এই বিষয়ে কোনও বাংলা ছোটগল্প ইতিপূর্বে পড়েছি বলে মনে পড়ছে না
ReplyDeleteকল্পবিজ্ঞান তো বটেই। তবুও এ এক ইউটোপিয়া, যেখানে আর্থিক বা অর্থনৈতিক সংকটের সঙ্গে লড়তে মানুষ এইভাবে উপায় খুঁজতে চাইবে। ম্যান ইন দ্য হাই ক্যাসলেও কিন্তু এমন সমান্তরাল পৃথিবীর ইঙ্গিত আছে। এক পৃথিবীতে মিত্র-শক্তি বিজেতা, আর এক পৃথিবী অক্ষ-শক্তির। দুটো পৃথিবী থেকে একই ব্যক্তির সত্ত্বা আসা-যাওয়া করে সাম্য বজায় রাখার চেষ্টা করবে। আসকের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তুলবে।
ReplyDeleteঅবশ্য সেখানে একটা ব্যাপার আছে, এক ব্যক্তি একই সঙ্গে দুই পৃথিবীতে জীবিত থাকতে পারবে না। হয় এখানে আছে, নাহ'লে ওখানে।
ভাল লাগল গল্পে এমন অভিনবত্ব।